এবারের অলিম্পিক বেশ অনেক কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রথমবারের মতন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোনো বেজোড় সংখ্যার বছরে। এর আগেও বিশ্বের উপর দিয়ে দূর্যোগ বয়ে গিয়েছে, দুই বিশ্বযুদ্ধের কারণে বন্ধ থেকেছে ৩টি অলিম্পিক। কিন্তু চার বছরের গ্যাপটা কোনোদিনও কমেনি। শুরু থেকেই যে অলিম্পিক ব্যতিক্রমী, সেখানে আরো ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটবে না তা কী কখনও হয়?
১১৩ বছরের অলিম্পিক ইতিহাসে যা হয়নি, সেটাই হয়েছে এই অলিম্পিকে। প্রথমবারের মতন অলিম্পিকের স্বর্ণপদক ভাগাভাগি করে নিয়েছেন দুই অ্যাথলেট। কাতারের মুতাজ ঈসা বারশিম ও ইতালির জিয়ানমারকো তামবেরি গড়েছেন বন্ধুত্বের অনন্য এক নিদর্শন, নিজেরা পদক ভাগাভাগি করে।
ঘটনার শুরু গতকাল অলিম্পিকের হাই জাম্প ইভেন্টে। হাই জাম্প ইভেন্টের ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছিলেন মোট ১৩ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২.৩৭ মিটার উচ্চতা পার করতে পেরেছিলেন মাত্র ৩ জন। ফাইনাল রাউন্ডে কয়েকজন প্রতিযোগী একই উচ্চতা পার করলে তাদের সুযোগ দেওয়া হয় উচ্চতা বাড়িয়ে। ২.৩৭ মিটার আরামসে পার হয়ে যাওয়ায় তিনজনকেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ২.৩৯ মিটার পার হওয়ার। কিন্তু তিনজনের কেউই সেই বাঁধা পার হয়ে পারেননি। তিনজনই ফাইনালে হাইটে এসে আটকে গিয়েছেন।
এরপর ম্যাচ অফিসিয়াল এসে দুইজনকেই প্রস্তাব দেন তারা কী জাম্প-অফ করতে চান কীনা। এখানে একটু নির্দিষ্ট উচ্চতা দেওয়া হবে, যে সেই উচ্চরা পার করে বেশি উঁচুতে উঠতে পারবেন, তিনিই হবেন স্বর্ণজয়ী তারকা। এই হিসাব থেকে বাদ যান বেলারুশের মাকসিম নেদাসেকাউ। কারণ এই রাউণ্ডে উঠবার আগে বেশ কয়েকবার পেনাল্টি পেয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে মুতাজ ঈসা বারশিম ও জিয়ানমারকো তামবেরি ছিলেন পুরোপুরি ক্লিন। ২.৩৭ মিটারের জাম্প নেওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ একবারের জন্যও কোনো পেনাল্টি পাননি। ফলে সুযোগটা ছিল তাদের দুইজনের জন্য। ফাইনাল একটা কাম্প, যে সবচেয়ে উঁচুতে উঠতে পারবেন, তার কাছেই যাবে স্বর্ণপদক।
কিন্তু ঈসা বারশিম যেন নিজের বন্ধুকে রেখে উপরে উঠতে চাচ্ছিলেন না। একসাথে এতটা পথ হেটেছেন দুজনে, পোডিয়ামে তার সাথে দাড়াতেও তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তাই তৎক্ষণাৎ সেই কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা দুজন কি দুটি সোনার পদক পেতে পারি না?’
দুজনে ব্যাপারটা নিয়ে একবারও কথা বলেননি, কেউ কারো সাথে আলোচনাও করেননি। তারা যেন জানতেন অপরের ইচ্ছেটা ঠিক কী। সেই কর্মকর্তা মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘হ্যা, সেটাও সম্ভব।’ বেশ তার সাথে সাথে উল্লাসে মেতে উঠলেন দুই অ্যাথলেট। আনন্দে একে অপরকে জটিয়ে ধরলেন। উল্লাসে দুজনে মত্ত হলেন একসাথে। বন্ধুত্ব বোধহয় একেই বলে।
তাদের বন্ধুত্বের শুরু এই হাই জাম্পের মঞ্চ থেকেই। ২০১৬ রিও অলিম্পিকের আগে আগে নিজের গোড়ালি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন জিয়ানমারকো তামবেরি। বিশাল এক রিহ্যাবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। লড়াই করতে হয়েছিল নিজের সাথে নিজেরই। কিন্তু তবুও নিজের সেরা ফর্মে ফেরা সম্ভব হচ্ছিল না তার।
বছরখানেক পরেও যখন নিজেকে ফিরে পাচ্ছিলেন না তামবেরি, প্যারিসে ডায়মন্ড লিগে ওপেনিংও ক্লিয়ার করতে পারেননি যখন, তখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই ঈসা বারশিম। একা একা সেদিন ড্রেসিংরুমে কাদছিলেন রামবেরি। তখন তার কাছে এগিয়ে এসেছিলেন ঈসা। তার কাছে এসে স্বান্তনা দিয়েছেন, একসাথে পথচলার অঙ্গীকার করেছেন।
আর সে পথচলাই সম্পন্ন হয়েছে এই ২০২১ সালে এসে। একসাথে দু’জন ট্র্যাকে দৌড়েছেন পতাকা নিয়ে। পোডিয়ামেও উঠেছেন একসাথে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। একসাথে বেজেছে দুই দেশের জাতীয় সংগীত। সেই সাথে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন বন্ধুত্বের নিদর্শন দিয়ে।