বিরাটের ব্যাটে পাঙচার হয়ে গিয়েছিল মালিঙ্গার প্রেস্টিজ!

ফাইনালের আগে কিনে আনে জার্সি। জমানো টাকায়। খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখে ছবি। বন্ধুরা মিলে ঠিক করে একসাথে খেলা দেখবে ঐ দিন। মেজমা কিনে দেয় একটা থাম্বস আপের বোতল। তাতে শচীন-শেবাগের ছবি। এক বন্ধু কিনে আনে পোস্টার কালার-তুলি।

এগারো বছরে কত কিছু বদলে যায়। জলপাইসবুজ প্যান্ট পরে একটা ছেলে সাইকেলে প্যাডেল করে প্রাণপণে।স্কুল ফেরত অঙ্ক টিউশন। স্যার ছুটি দিয়ে দেন তাড়াতাড়ি। আজ সেমিফাইনাল। গলির মোড়ে মোড়ে জটলা থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্র শেবাগের নাম।

উমর গুলকে নাকি শুরুতেই মাঠের বাইরে ফেলছে বীরু। ছেলেটার মাথায় ইন্ডিয়ার তেরঙা ফেট্টি বাঁধা। ক্লাবঘরগুলো ভরে উঠেছে। ঘরে ঢুকেই টিভি চালিয়ে দেয় ও। পিঠের ব্যাগ সোফায় ছুঁড়ে দুহাতে তালি দিয়ে বসে পড়ে মাটিতেই। ভারত হারিয়ে দেয় পাকিস্তানকে। বিশ্বকাপ? কী? এও কি সম্ভব? তিরাশির শুধু গল্প শুনেছে ও।

ফাইনালের আগে কিনে আনে জার্সি। জমানো টাকায়। খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখে ছবি। বন্ধুরা মিলে ঠিক করে একসাথে খেলা দেখবে ঐ দিন। মেজমা কিনে দেয় একটা থাম্বস আপের বোতল। তাতে শচীন-শেবাগের ছবি। এক বন্ধু কিনে আনে পোস্টার কালার-তুলি।

ম্যাচ শুরু হতে বাকি কিছুক্ষণ। গরমে গলে যাচ্ছে গালের তিনটে রঙ। জাহির উইকেট নেবে। তারপর ঘেমে স্নান হয়ে ওরা সবাই দাঁত দিয়ে নখ খাবে। জয়বর্ধনে সেঞ্চুরি হাঁকাবেন। কাঠফাটা রোদে মাথা ঝিমিঝিম করবে দুশো চুয়াত্তর রান দেখে। মালিঙ্গা হাসবেন।

শচীন আউট। শেবাগ আউট। একটা চৌকোঘরে শান্ত হয়ে গেছে ছেলেটা। ওর বন্ধুরা। মাঝে কেউ চা দিতে এলে বাজে ভাবে চেঁচিয়ে উঠেছে। পরে কষ্ট পেয়েছে। সৌরভের ভারত, জোহানেসবার্গ, ম্যাকগ্রা, তিনশো ঊনষাট, না! ভাবতে পারছে না আর। চোখ জ্বালা করছে খুব।

একটা গোলগাল মুখের ছেলে নামল। ওয়াংখেড়েতে পিন ড্রপ সাইলেন্স। মালিঙ্গার ওভারে কয়েকটা বল বাকি। সচিনকে খেয়েছে। বীরুকেও। এই বাচ্চা ছেলেটাকে তো চিবিয়ে খাবে ঝাঁকড়া চুলের সিংহলী। একটা পাতলা ব্যাট। টিক চিহ্ন দেওয়া। চোখদুটো! কী অসম্ভব জোরালো, যেন একটা বিশ্বাস লেগে আছে।

পারতেই হবে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে দেওয়াল জুড়ে লিখতে হয়। মালিঙ্গা আবার গুড লেংথ দেবে। আগুনে পেসে। ঠিক পা বাড়িয়ে মিডব্যাটে জমাবে ছেলেটা। একটা নয়। পরপর তিনটে। আমরা একটু নড়েচড়ে বসব। গম্ভীর আসবে পরের ওভারে। আপাতত, এই ছেলেটা, পারল? পারল তো! এই বাচ্চা ছেলেটাই তো পারল!

পেরেছিল। সত্যিই পেরেছিল সেদিনের পুচকে বিরাট কোহলি। এই পঁয়ত্রিশটা রান যে সাঁকো গড়েছিল সেদিন, আজকের রেকর্ডের ইমারতকে সে মুখ বেঁকিয়ে হাসে। দিলশানের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পর কেটে গেছে এগারোটা বছর। সেদিনের ক্লাস টেনের ছেলেটা এখন খেলা দেখে হটস্টারে৷ সেই পেটমোটা টিভি আর নেই।

টিউশন থেকে ঘরে ফেরার তাড়া নেই। জটলা থেকে স্কোর জেনে নেওয়ার রোমাঞ্চ নেই। অফিসের মাঝে স্কোর চেক করার জন্য ক্রিকবাজ আছে। ছেলেটা বড় হয়ে গেছে। যেমন বড় হয়ে গেছেন বিরাট কোহলি। সত্তরটা সেঞ্চুরির মালিক এখন দেশের সবচেয়ে বড় সেনসেশন।

তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হয়৷ তাঁকে নিয়ে বিষাদ-হরষের পানসি ভাসে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি। অথচ আমার কাছে বিরাট কোহলি মানে সেদিনের শক্ত চোয়ালে মিডব্যাটে, ফ্রন্ট আর ব্যাকফুটে গিয়ে খেলে দেওয়া মালিঙ্গার চার-পাঁচটা আগুনে ডেলিভারি যা মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারত একশো কোটির স্বপ্ন। বিরাটের ব্যাটে পাঙচার হয়ে গিয়েছিল মালিঙ্গার সেদিনের বিষাক্ত স্পেলের শেষ ছোবলগুলো।

মাহি-গম্ভীরের ইনিংস নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় জাহিরের বোলিং নিয়ে। আলোচনা হয় যুবির অতিমানবিক হয়ে ওঠা লড়াইগুলো নিয়ে। বিরাট নিয়ে কথা হলেই আসে রেকর্ড, রেকর্ড আর রেকর্ড। তা আসাই স্বাভাবিক, দস্তুর। তবে বিরাট কোহলি হয়ে ওঠার আগে থেকে কোথাও যেন আমরা একই সাথে বড় হলাম। বুড়ো হলাম।

এগারো বছরে কতকিছু বদলে যায়। যেমন এই ফ্রেমটা। যেমন বিরাট কোহলি। যেমন আমি। যেমন আপনি। যেমন সময়। যেমন ক্রিকেট। শুধু থেকে যায় নদীর পাড়ে এসে শুকিয়ে যাওয়া পুরোনো জলের দাগ। দুই এপ্রিল এলে আমাদের মাঝে মধ্যে এসব মনে পড়বে। পড়বেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...