আরেকজন কপিল আসবেন না!

হিরো কাপ ফাইনালের পরের দিন আজকাল পত্রিকায় একটা ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। আগেরদিন ইডেনে ‘বুড়ো’ কপিল দেবের ফলো থ্রুতে রিচি রিচার্ডসনের ক্যাচ নেওয়ার মুহূর্ত (চিত্র সংগ্রাহক সম্ভবত সুমন বাবু, ভুল হলেও হতে পারে)। সঙ্গে ক্যাপশন ‘কে বলে কপিল শেষ’।

হিরো কাপ ফাইনাল মানেই অনিল কুম্বলের ১২ রানে ৬ উইকেট। কিন্তু তার তলায় চাপা পড়ে যায় চরম অপমানিত এক জাঠের ১০-৩-১৮-২ সঙ্গে ওই মধ্য তিরিশেও নিজের বলে নেওয়া রিচার্ডসনের ক্যাচটা। অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন সেদিন নতুন বল যে কপিলের হাতে তুলে দেননি সেটা ভিন্ন বিষয়, তার থেকেও মারাত্মক বিষয় ছিল সেমিফাইনালে ভালো বল করায় সেদিন ভারতের হয়ে ফার্স্ট চেঞ্জ বোলার হিসেবে আসেন অজয় জাদেজা, তারপর কপিল!

অনেকেই কমেন্ট বক্সে রে রে করে ছুটে আসবেন বাছাই করা শব্দ নিয়ে জেনেও বলছি এই জায়গাটায় অধিনায়ক হিসেবে আজহার আর মহেন্দ্র সিং ধোনির মধ্যে ভীষণ মিল খুঁজে পাই; সিনিয়র ছাঁটাই। ইডেনের ওই সন্ধ্যের মাস দুয়েকের মধ্যে আহমেদাবাদে রিচার্ড হেডলিকে টপকে যাওয়ার পরে ম্যাচ শেষে ম্যাচের সেরা আজহার ক্যামেরার সামনে হাসি হাসি মুখে তাঁর পুরস্কারটা তুলে দিলেন কপিলের হাতে আর ঠিক তার দুই মাস বাদেই ওয়েলিংটনে একটা বাজে স্পেল তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দিল টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনা থেকে।

এটা তর্কহীনভাবে ঠিক যে ভারতীয় ক্রিকেটে একমাত্র সুনীল গাভাস্কার আর কিছুটা সৌরভ গাঙ্গুলি বাদে সবাই তাঁদের বিদায়ক্ষন নির্ধারণে ভুল করেছেন। কপিল ও সেই দলে পড়েন। বলের গতি কমে গিয়েছিল, হয়তো হেডলির রেকর্ডের হাতছানি না থাকলে আজহার ও এরকম একজন সিনিয়রকে এত দিন সহ্য করতেন না। কিন্তু কপিল যে প্রতিভা, যে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটকে যা দিয়েছেন তাতে করে আরও ভাল বিদায় কাম্য ছিল।

কপিল দেব মানেই আপাত দৃষ্টিতে ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়, ১৭৫ এর অবিশ্বাস্য ইনিংস, ভিভের ক্যাচ, ‘৮৭ তে গুচের সুইপের জন্য দায়ী করা, ইডেনের সেই বিতর্কিত আউট। কিন্তু কপিল মনে এগুলোর কিছুই না। কপিল হলো ভারতীয় ক্রিকেটের মূর্তিমান স্পর্ধা, যে বিপক্ষ ব্যাটসম্যান কে বাধ্য করবে ড্রেসিংরুম থেকে হেলমেট চেয়ে পাঠাতে, প্রকাশ্যে বলতে পারবে যে তাহলে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কাউকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হোক ইংরাজি বলার জন্য, আর আমি বরং মন দিয়ে ক্রিকেটটা খেলি ( অধিনায়কের ইংরাজি বলার সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে)।

কপিল মানেই দল যখন চরমতম বিপদে তখনই বেরিয়ে আসা দুর্ধর্ষ স্পেল বা একটা অতি প্রয়জনীয় ক্যামিও ইনিংস যা বদলে দেবে পুরো ম্যাচ। বিশ্বকাপে করা ১৭৫ তো বহুল চর্চিত। ক্রিকেট জীবনের সায়াহ্নে এসেও আগুনে ডোনাল্ডের সামনে ও দেশের মাঠে করেছিলেন একটা ১২০, যখন নেমেছিলেন দল তখন ২৭/৫। এই ঘটনা একবার না বার বার হয়েছে কখনো ব্যাট হাতে তো কখনো বল হাতে।

অস্ট্রেলিয়া বা পাকিস্তানের মতো প্রিয় মৃগয়া ক্ষেত্রের কথা ছেড়ে দিন, ভারতের মরা পিচে ফাস্ট বোলার হিসেবে ৯ উইকেট এক ইনিংসে (সেটাও ম্যাচের তৃতীয় ইনিংসে)! অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। আর তার চেয়েও অবাক করার বিষয় একজন প্ৰকৃত ফাস্টবোলার যিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী ছিলেন একটা সময়, তাঁর ৫০ শতাংশের ওপর শিকার এসেছে ভারতের বধ্য ভূমি থেকে। এই একটা পরিসংখ্যানই বোধ হয় যথেষ্ট প্রতিভার অনেক উপরে থাকা তাঁর জেদ আর ফিটনেসকে বোঝাতে।

হ্যাঁ ফিটনেস। ইয়ো-ইয়ো টেস্টের আবিষ্কর্তারও বোধ হয় জন্ম হয়নি তখন, যখন কপিল তার কেরিয়ার শুরু করেন। নূন্যতম জিম সুবিধাও তখন বোধহয় ভারতের হাতে গোনা কয়েকটা স্টেডিয়ামে ছিল। কিন্তু তা সত্বেও দীর্ঘ ১৬ বছরের কেরিয়ারে একটা টেস্টেও চোটের জন্য বাইরে বসতে হয়নি। একটা স্পেল বল করে বাইরে যেতে হতো না বরফ লাগাতে। দিনের পর দিন টেস্টে এক দিনে ২৫ ওভার, কখনো ৩০ ওভারও বল করেছেন।

অবাক লাগে যখন দেখি আজকের এই ফিটনেস ফ্যানটিক যুগে যখন কেউ পরপর দুটো সিরিজ খেলতে পারে না। শুধু দৌড় আর দৌড়ের উপর নির্ভর করে এমন একটা ফিটনেস লেভেল ধরে রেখেছিলেন যাতে করে ২৫/৩০ ওভার বল করে উঠে আবার একটা শতরান হাঁকাতে পারতেন। পারতেন হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিকে সঙ্গে নিয়েও পাঁচ উইকেট নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দশ দিনের মধ্যে পরের ম্যাচে নেমে পড়তে।

কারো কয়েকটা বিক্ষিপ্ত সাফল্যের পরে যখন এই মানুষটার সঙ্গে তুলনা টানা হয় বা বলা হয় ভবিষ্যতের কপিল তখন প্রায় আঠাশ বছর আগে করা তাঁর ঐইতিহাসিক বক্তব্যটাই মনে পড়ে যায়, ‘My mom is too old & father is not alive, so you can’t produce another Kapil।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link