দক্ষিণ আফ্রিকা তো বটেই ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম চৌকস অধিনায়ক হিসেবে উচ্চারিত হতো নাম। সম্ভাবনা ছিল বিশ্বকাপ জিতে ক্লাইভ লয়েড, ইমরান খান, অ্যালান বোর্ডারদের পাশে নাম লেখানোর। ব্যাটসম্যান হিসেবেও ছিলেন সমান সম্ভাবনাময়। কিন্তু সব সম্ভাবনাকে ধুলোয় মিশিয়ে অন্ধকারের পথে যাত্রা তার। জড়িয়ে পড়েন ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাথে। মুহূর্তে নায়ক থেকে বনে যান খলনায়ক। তিনি হ্যান্সি ক্রনিয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার ট্র্যাজিক হিরো।্
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে জন্ম ক্রনিয়ের। ছোটবেলা থেকে বড় ভাই ফ্রান্স ক্রোনিয়ের সাথে মাঠে যেতে যেতেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। দুই ভাইয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে শুরুটা একই দলের হলেও ফ্রান্স খুব একটা এগোতে পারেননি। অন্যদিকে নিজের একাগ্রতা, শ্রম দিয়ে হ্যান্সি সামনে এগিয়েছেন দ্রুততার সাথে। ২২ বছর নির্বাসন থেকে ফেরার পর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপেই জায়গা করে নেন। পরের বছরেই কেপলার ওয়েসেলসের চোটের সুবাদে প্রথমবারের মতো নিযুক্ত হন অধিনায়ক হিসেবে। তার নেতৃত্বে যেন নতুন করে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
৫৩ টেস্টে অধিনায়কত্ব করে জয় তুলে নেন ২৭ টেস্টেই। আর ১৩৮ ওডিয়াইতে জয় পেয়েছিলেন ৯৯ ম্যাচেই। দক্ষিণ আফ্রিকা তাকে ঘিরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিল। বলা হতো, নেলসন ম্যান্ডেলার পর দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি ক্রোনিয়ে। কিন্তু ১৯৯৯ বিশ্বকাপে হার্শেল গিবসের ক্যাচ মিস কিংবা স্টিভ ওয়াহ এর অতিমানবীয় সেই ইনিংসে সেমিতেই বিদায় নিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
তবে তাঁর আগের বছরেই দলকে জিতিয়েছিলেন মিনি বিশ্বকাপের (বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি) শিরোপা। তার আমলেই প্রথমবারের মতো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। হার্শেল গিবস, মাখায়া এনটিনিদের কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটা তার ছত্রছায়াতেই। অ্যালান ডোনাল্ড একবার বলেছিলেন হ্যান্সির জন্য দলের সবাই জীবন দিতে রাজি।
‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়।’ – জীবনানন্দের এই কবিতার মতোই ক্রোনিয়ের সুন্দর দিনগুলো ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে। অর্থের লোভে ক্রোনিয়ে পা বাড়ান ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের দিকে। ২০০০ সালের ৭ এপ্রিল দিল্লী পুলিশ রীতিমতো ক্রিকেট বিশ্বে বিস্ফোরণ ঘটায়। তারা দাবি করে হ্যান্সি ক্রনিয়ে আর ভারতীয় বাজিকর সঞ্জয় চাওলার ফোনালাপ তাদের কাছে আছে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন দুজন।
ক্রনিয়ে ছাড়াও অভিযোগের তীর ছোটে হার্শেল গিবস, নিকি বোয়ে, মোহাম্মদ আজাহার উদ্দিন, অজয় জাদেজা, মনোজ প্রভাকরদের দিকে। ক্রোনিয়ে প্রথমে সবকিছু অস্বীকার করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বোর্ডও সমর্থন জানায় তাঁদের অধিনায়ককে। ১১ এপ্রিল, রাত তিনটা। ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান আলী বাখেরের টেলিফোনে কল আসে, দাতা হ্যান্সি ক্রনিয়ে। অনুশোচনায় ভুগতে থাকা ক্রোনিয়ে স্বীকার করে নেন সবকিছু।
জানান লন্ডনের এক বাজিকরের থেকে ম্যাচের পূর্বাভাস দেয়ার বিনিময়ে দুবার করে মোট ২৫ হাজার ডলার নেন। এরপরই তাকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে তার আরো অপকর্মের কীর্তি। প্যাট সিমকক্স জানান একদিনের ম্যাচে ইচ্ছা করে হেরে যাবার জন্য পুরো দলকে ২৫০,০০০ ডলারের প্রস্তাব দেন তখনকার দলনেতা ক্রনিয়ে। হার্শেল গিবস তার বিপক্ষে স্বীকারোক্তি দেন, জানান নাগপুরে তাকে বিশ রানের কমে আউট হওয়ার বিনিময়ে ১৫০০০ পাউন্ডের প্রস্তাব দেন। এক মাস পর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তাকে। মুহূর্তের ব্যবধানে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন হ্যান্সি ক্রোনিয়ে।
সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ক্রনিয়ে নিজেকে সংবাদমাধ্যম থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। অ্যাকাউন্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন, সপ্তাহান্তে ফিরে যেতেন স্ত্রীর কাছে। তেমনি এক মিটিং শেষে সোয়াজিল্যান্ড থেকে ফিরছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে রাস্তায় জ্যামের কারণে ফ্লাইট মিস করেন। প্রচণ্ড শীত আর স্ত্রীর সান্নিধ্য মিস করতে চাইছিলেন না ক্রনিয়ে।
ফলে নিজের সুবিশাল ভিলায় থাকা আর গলফ খেলার প্রস্তাব দিয়ে রাজি করিয়ে ফেলেন রানওয়েতেই থাকা কার্গো প্লেনের দুজন পাইলটকে। পুরো যাত্রাটা ঠিকঠাক থাকলেও সেন্ট জর্জ বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময় গড়মিল পাকিয়ে ফেলেন বিমানের পাইলট। প্রথমবার অবতরণ করতে গিয়ে কুয়াশার কারণে ব্যর্থ হন। বিমানের পাইলট দুজনও বেশ আত্নবিশ্বাসী ছিলেন দ্বিতীয়বারে ঠিকভাবে ল্যান্ডিং করাতে পারবেন।
নিজেদের মাঝে রসিকতাও করছিলেন এ নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয়বার ঠিক মতো রানওয়ে আন্দাজ করতে না পারায় বিমান গিয়ে আছড়ে পড়ে পাশের পাহাড় ক্র্যাডকে। পুরো বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। ক্রনিয়ের পাশাপাশি পাইলট দুজনও সেদিন মারা যান। ধারণা করা হয় বাজে আবহাওয়া আর তীব্র বাতাসের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ক্রনিয়ের মৃত্যুর খবর প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী। এমনকি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া বিমানের মালিকের দাবিও ছিল সেদিনের বিমান দুর্ঘটনা আসলে হত্যাকান্ড।
তাঁর ভাষ্যমতে, ‘এর চাইতে খারাপ আবহাওয়াতেও আমাদের পাইলটরা নিরাপদেই রানওয়েতে বিমান অবতরণ করিয়েছে। অথচ সেদিনের আবহাওয়া তেমন খারাপও ছিল না। ওই রুটে নিয়মিতই তাঁরা যান এবং কোনোদিনই কোনো সমস্যা হয়নি।
এমনকি ক্রনিয়ের মৃত্যুর তদন্ত করা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছিলেন, ‘পুলিশ ক্রনিয়ের মৃত্যুতে স্যাবোটাজের আলামত পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা জনগণের সামনে সত্যটা উন্মোচিত করতে চাচ্ছে না। অনেকেই আছেন যারা চান ক্রনিয়ে জীবিত না থাকুক। তাঁরা ভয় পাচ্ছিল ক্রনিয়ে সত্যটা সবার সামনে উন্মোচিত করে দেবেন। এমনকি যারা ঘটনাটা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিল তাদেরকেও মৃত্যুর হুমকি দিয়ে চুপ করে ফেলা হয়েছে।’
পৃথিবীর অনেক অমীমাংসিত রহস্যের মতোই ক্রনিয়ের মৃত্যুও রয়ে যাবে রহস্য হয়েই।