১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি; ডিন ওয় খেলছেন সিডনির ডিভিশন ক্রিকেট। ডানহাতি ব্যাট বাউন্সি উইকেটে সমস্যায় পড়ছেন। বোলার এসে স্লেজ করে চলে গেল, ‘তুমি নিশ্চিত যে, তোমাকে দত্তক নেওয়া হয়নি?’ ডিন তো তবু একটা ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে। ড্যানিয়েল তো অনূর্ধ্ব-উনিশের উপর উঠতেই পারেননি। বিখ্যাত দাদাদের ভাইদের এসব সমস্যা হয়েইছে। এমনকি ট্রেভর চ্যাপেল, যিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়েও খেলেছেন, তাঁকেও সময়ে-সময়ে শুনতে হয়েছে ট্যালেন্টহীনতার কথা। কিন্তু আমরা তো ডিন বা ড্যানিয়েলকে নিয়ে ঘাঁটতে বসিনি।
ডিনের জন্ম থেকে আরও চার বছর পিছিয়ে গেলে দেখব, ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বাধিক পরিচিত যমজের জন্মগ্রহণ সে-বছরই। ১৯৬৫। স্টিভ এবং মার্ক ওয়। স্টিভ বড়ো চার মিনিটের। আর তাতেই বোধহয় সবকিছু আগে আগেই পেতে শুরু করলেন। অবশ্য তাঁদের মা বলেন, মার্ক শুরু থেকেই গোছানো এবং চুপচাপ ছিল। স্টিভ ফেলে ছড়িয়ে একশা এবং সবকিছুতেই মতামত জাহির করনেওয়ালা। এভাবেই শুরু হয়।
বরাবরের চুপচাপ মার্ক পিছিয়ে পড়ে এইজন্য, যে, সে নিজের বক্তব্য জাহির করে না। এমনকি এসেক্সে থাকাকালীন কোচ ববি সিম্পসনের কাছেও শুনতে হয়েছিল, মার্কের পরিশ্রম বা খেলার বিষয়ে অনীহার কথা।
অথচ স্টিভ শুরু থেকেই গো-গেটার। ১৯৮৫-৮৬-তেই অলরাউন্ডার হিসাবে ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে স্টিভ শুরু করলেন টেস্ট। ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সীমিত ওভারে। সীমিত ওভারেই বেশি নাম করে ফেললেন স্টিভ। ডেথ ওভার স্পেশালিস্ট। স্লগ ওভারে ব্যাট চালানো বা বেল ওড়ানো, উভয় ক্ষেত্রেই ঠান্ডা মাথার জন্য নাম হল তাঁর। ৮৭-এর বিশ্বকাপের গ্রুপের ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে মনিন্দার সিংকে আউট করে ম্যাচ জেতালেন।
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে ৭ রান দরকার ছিল, দিলেন ৩। ভারতের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে তিনটে চার একটা ছয় মেরে সতেরো তুললেন। স্টিভ আর সাইমন ওডোনেলের উপর ভরসা করে সেবার বিশ্বকাপ জিতল অস্ট্রেলিয়া। লিলি-মার্শ-চ্যাপেল-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হল।
টেস্টে তখনও জায়গা করতে পারেননি তেমন। তবে বলার মতো ঘটনা ঘটল ব্রিসবেনে। বিশ্বত্রাস ভিভ রিচার্ডসকে সামান্য মিডিয়াম পেসেই বাউন্সার বৃষ্টি করলেন স্টিভ। ভিভের চোখে চোখ রেখে সরালেন না। এমনি আর-একবার হয়েছিল ১৯৯৫-৯৬-এ, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাত থেকে টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বসেরার মুকুট সরকারিভাবে অস্ট্রেলিয়ার হাতে এল। নব্বইয়ের সেরা পেস বোলার কার্টলি অ্যামব্রোসের চোখে চোখ রেখে লড়ে গেলেন স্টিভ।
আর এই চোখে চোখ রেখে লড়ে যাওয়াটাই সাধারণ ব্যাটসম্যান থেকে স্টিভ ওয়কে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের শ্রেণিতে নিয়ে ফেলল। ১৯৮৯-এর ইংল্যান্ড ট্যুর। প্রায় সাত বছর অ্যাশেজ অধরা থেকে গেছে অস্ট্রেলিয়ার। বর্ডারের নেতৃত্বে তরুণ অস্ট্রেলিয়া। টেলর মার্শ বুন জোন্সের ব্যাটিং আর অল্ডারম্যান লসন মার্ভ হিউজের বোলিং। কিন্তু ব্যতিক্রমী পারফর্মার হিসাবে সকলের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন স্টিভ রজার ওয়াহ। প্রথম দুই টেস্টে অপরাজিত সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইন আপের ছ-নম্বর জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিলেন স্টিভ। অন্তত তাই-ই মনে হয়েছিল।
কিন্তু ৯০-৯১-তে অ্যাসেজে খারাপ ফর্মের জন্য বাদ গেলেন স্টিভ, দলে এলেন মার্ক। এ যেন ৯০-এর রঞ্জি ফাইনালে স্নেহাশিসকে সরিয়ে দলে আসা সৌরভের। মার্ক সেই মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখলেন অভিষেকেই দৃষ্টিনন্দন সেঞ্চুরি করে।
আসলে মার্ক ওয়াহ আর স্টিভ ওয়াহর ব্যাটিং আদতেই শুক্তো আর পায়েসের মতো। স্টিভ লড়ে নেবেন, খুব দ্রুত কম ব্যাকলিফটে ঝুঁকে কভার ড্রাইভ বা স্পিনারকে সপাটে কাউ কর্নার। সেখানে মার্কের ব্যাটিং যেন বেহালায় ছড়ের টান, বাঁহাতি ডেভিড গাওয়ার, মসৃণ রোলস রয়েস। ব্যাট হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন যেন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি। বাঁ হাতের ভি-টা লম্বাটে হয়ে গ্রিপ করে আছে, মুঠো নয়, যেন পালক ধরে আছেন মার্ক। ডান হাত আলগা করে তার ইঞ্চিখানেক নিচে। বল পড়ল গুড লেন্থে, বল বাঁকল হালকা, আউটস্যুইং। মার্ক ফোর্থ স্টাম্প বরাবর পা নিলেন, ব্যাট শেষ মুহূর্তে তুললেন, এবং শেষ মুহূর্তে বোলালেন বেরিয়ে যাওয়া বলটার উপর। বাঁ হাতের কনুই বাঁকা রইল। ডান হাত পরিচিত ঘোড়ার ঘাড়ের রোঁয়ে হাত বুলিয়ে দিল। ডান হাঁটু ঈষৎ বাঁকা, বল ছুটল বাউন্ডারির বাইরে।
একই বল, স্টিভ ব্যাটকে প্রায় মাটির সমান্তরালে নিয়ে গিয়ে একটা হাফ কক ফরোয়ার্ড শাফল করবেন, তারপর বডিওয়েট সামান্য পিছনের দিকে নিয়ে সাঁ করে ব্যাট ঘোরাবেন। বাঁ পা-টা স্ট্রোক শেষ করার পর একটু পিছিয়ে যাবে লেগ স্টাম্পের দিকে, ফল একই।
এভাবেই দুই ভাই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের নবজাগরণের ভরকেন্দ্রে বিচরণ করা শুরু করলেন। মার্ক শুরুতে মিডিয়াম পেস করতেন। স্টিভও। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দুজনেরই ভার্টিব্রায় সামান্য ফাঁক দেখা দিল। ফলস্বরূপ মার্ক স্পিন করতে শুরু করেন আর স্টিভ ধীরে ধীরে বোলিংই ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তদ্দিনে ৯৬-এর বিশ্বকাপ হয়ে গেছে। মার্ক ওয়কে ব্যাটিং ওপেন করতে দেখা যাচ্ছে অধিনায়ক মার্ক টেলরের সঙ্গে একদিনের ম্যাচে। এবং ধীরে ধীরে শচীন টেন্ডুলকার ও ব্রায়ান লারার সঙ্গে একদিনের খেলায় নিজেকে সর্বোচ্চ শ্রেণির ব্যাটসম্যান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন মার্ক ওয়। বিশ্বকাপেও তিনটে সেঞ্চুরি। একটি ফেভারিট ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ কোয়ার্টার ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
১৯৯৫-এ স্টিভ একটা কেরিয়ার ডিফাইনিং সিরিজ খেলে ফেলেছেন। অস্ট্রেলিয়া ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারিয়েছিল ১৯৭৮-এ। সেই লিলি টমসনের ৫-১ দুরমুশ করার পরের সিরিজ থেকে। ১৯৯৫-৯৬-তে। নবীন দুই পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা আর পল রাইফেলের উপর ভর করে সিরিজ আর ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ট্রফি ফিরিয়ে নিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আর সেইসঙ্গে টেস্টের এক নম্বরের মুকুটও। লো স্কোরিং এই সিরিজে স্বতন্ত্র ভূমিকায় নামলেন স্টিভ। নো রিস্ক ক্রিকেট খেলতে তদ্দিনে হুক ছেঁটে ফেলেছেন তূণীর থেকে। তা বলে কি অ্যামব্রোস ওয়ালশ বেঞ্জামিন শুনবেন? তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ১২৭-এর মধ্যে স্টিভ একাই ৬৩ নট আউট।
অ্যামব্রোসের সঙ্গে ঝামেলা বেধে গেল। অধিনায়ক রিচার্ডসন অ্যামব্রোজকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। তারপর যেটা চলল, সেটা বোধহয় আধুনিক ক্রিকেটের লোকগাথার অন্তর্গত হয়ে গেছে। গায়ে মাথায় বুকে পিঠে বল খেতে লাগলেন, কিন্তু আউট হবেন না। সহজ হিসাব, অ্যামব্রোজ তখন খ্যাপা ষাঁড়। অফ দ্য পিচ সিম করছে বল, কোনোটা বাইরে ফ্লোট করছে, কোনোটা হিংস্র নেকড়ের মতো ঢুকে আসছে গায়ে। স্টিভ, নিজের পা অফ স্টাম্পের বাইরে একেবারে আট্টহা দিয়ে যেন আটকে দিলেন। এলবিডব্লিউর সম্ভাবনা কমে গেল। এরপর রিফ্লেক্স আর ধৈর্যর উপর ভরসা করে টুকটাক খেলা চলতে লাগল। আউটসাইড দ্য অফ স্টাম্প বল কাট সিম করে বেরিয়ে গেলে শেষ মিনিটে কভার বা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের দিকে ঠ্যালা। গায়ের দিকে বল ঢুকলে শেষ পর্যন্ত দেখে স্কোয়ারলেগের দিকে চাঁটানো। এই করেই ৬৭।
জাস্টিন ল্যাঙ্গার পরে বলেছিলেন, পোর্ট অব স্পেনের সবুজ উইকেটে সেকালের সম্ভবত সেরা পেস বোলারের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াই করায় যে বিদ্যুৎ ছিল, তা সারা দলের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। ফলস্বরূপ ১-১ অবস্থায় চতুর্থ টেস্ট ইনিংসে জিতল অস্ট্রেলিয়া। জামাইকার মাটিতে ভাই মার্ককে নিয়ে দ্বিশতরানের পার্টনারশিপ। মার্কের সেঞ্চুরি। স্টিভ থামলেন ২০০-য়। তদ্দিনে বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট ব্যাট হয়ে গেছেন স্টিভ।
এরকমই একটা ইনিংস ছিল মার্কের। ৯৭-এ পোর্ট এলিজাবেথ। বিপক্ষে ডোনাল্ড পোলক ম্যাকমিলান ক্রোনিয়ে ক্যালিস এবং অ্যাডামস। প্রথম ইনিংসে ১০১ রানের লিড দিয়ে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে গেল অস্ট্রেলিয়া। ম্যাথু এলিয়ট ৪৪-এর একটা ইনিংস দিয়েছিল, তা ছাড়া পুরোটা মার্ক মার্ক এবং মার্ক। স্কোয়ার ড্রাইভ এবং ফ্লিকের জলতরঙ্গে ভেসে গেল পোর্ট এলিজাবেথ।
৫ উইকেটে ১৯২-এর পরে অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ে শেষ অস্ত্র হিসাবে বল তুলে দিয়েছিলেন ডোনাল্ডের হাতে। শ্বেত-বিদ্যুৎ। হাতে আছে একটা ভয়ংকর অফকাট, সিক্সথ স্টাম্পে পড়ে বল লেগ স্টাম্প উড়িয়ে দিতে পারে;সেই বলের ব্যালেন্স বজায় রেখে মার্ক একের পর এক মিড উইকেট দিয়ে ফ্লিক শুরু করলেন। আজহারকে লেগসাইডের খেলার জন্য নান্দনিক সম্রাট উপাধি দেওয়া হয়ে থাকে;সেদিন যেন মার্ক ওয় সেই মুকুট নিজের মাথায় পরে নিয়েছিলেন। আর অফ স্টাম্পের বাইরে? ম্যাকমিলান খান তিনেক স্কোয়ার ড্রাইভ ব্যাকফুটে। পিছনে ঈষৎ হেলে ব্যাট আগে বলের উপর নিয়ে যাওয়া, তারপর ডান হাতের চাপে তাকে বাউন্ডারিতে পাঠানো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও কোনও ঝটকা নেই, এক পোঁচে যেন উপত্যকায় ফুলের বন্যা ডেকে আনলেন মার্ক।
আর কত বলব! ২০০৩, ওয়ান ডে টিমে স্টিভ নেই, টেস্ট টিম থেকেও বাদ পড়ার ডাক এসে গেছে। সিডনি, ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের ৩৬২-র জবাবে স্টিভ যখন নামলেন, অস্ট্রেলিয়া ৫৬-৩। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা সিডনি বুঝে গেল যে, ঘরের ছেলের আজ ফিরিয়ে দেবার দিন। প্রথম দিকের জড়তা কাটিয়ে ব্যাট চলতে লাগল, কভার ড্রাইভ, মিড অফ দিয়ে চেক ড্রাইভ অথবা স্কোয়ার লেগ দিয়ে ফ্লিক। কবজির মোচড়ে আর-এক মহাকাব্য রচিত হল। দিনের শেষ বলে যখন বাউন্ডারি মেরে সেঞ্চুরিতে পৌঁছোলেন স্টিভ, ঘোষণা করে দিলেন যাবার আগে, চলে যাবার জন্য তিনি আসেননি। মার্ক তদ্দিনে খেলাই ছেড়ে দেবার মুখে। স্টিভ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর-এক বছর। শেষে নিজের মাটি সিডনিতেই ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ বাঁচিয়ে পন্টিংদের কাঁধে চড়ে বিদায় নিলেন স্টিভ।
স্টিভ ওয়াহ, খেলার বাইরের পৃথিবীর জন্যও অনেক কিছু রেখে গেছেন। কলকাতার কাছে ব্যারাকপুরের উদয়ন অনাথ আশ্রমের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সুবিদিত। ছবি তোলার জন্যও পরিচিত ছিলেন। শ্যেন ওয়র্ন যদিও বলেছেন যে স্টিভের মতো স্বার্থপর ক্রিকেটার তিনি দেখেননি। কিন্তু তবুও টেলএন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে যে পাতার পর পাতা রান বাড়িয়ে গেছেন সে তো সর্বজনবিদিত। এইখানেই ছেলেবেলার পার্থক্য যমজ ভাইয়ের সঙ্গে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। স্টিভ পণ করেছিলেন, ম্যাকগ্রাকে ব্যাটসম্যান বানিয়েই ছাড়বেন। অপর দিকে মার্ক মনে করতেন ম্যাকগ্রাকে ব্যাটিং শেখানো আর পেনসিল দিয়ে পার্মানেন্ট মার্ক করা একই ব্যাপার। গ্লেন গুরুদক্ষিণা দেন স্টিভের খেলা ছাড়ার পরেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রিসবেনে শেষ উইকেটে গিলেসপির সঙ্গে শতরানের পার্টনারশিপে নিজের একমাত্র পঞ্চাশ রান করার সঙ্গে সঙ্গে।
ক্যাজুয়াল ব্যাপারস্যাপার কি ছিল না মার্কের? এই যে ক্রনিয়ের থেকে আসা বুকিদের প্রস্তাব সম্পর্কে জানালেন না। অথবা পিচ বা দল সম্পর্কে তথ্য পাচার করলেন। এগুলো হয়তো সমস্ত ব্যাপারটাকে ক্যাজুয়ালি নিতে গিয়েই হল। কিন্তু মার্কের স্টাইলটাই সেরকম ছিল। স্লিপে দাঁড়িয়ে আছেন, ওয়র্নের বলে মার্লোন স্যামুয়েল স্কোয়ার কাট করেছেন। স্কোয়ার কাট ভেবে ডানদিকে সরতে শুরু করেছেন মার্ক, হঠাৎ টপ এজে বল বাঁ হাত পেরিয়ে এল। জাস্ট থলি থেকে ডিম বার করার মতো বাঁ হাত বাড়িয়ে ক্যাচ নিয়ে নিলেন মার্ক।
অথবা সেই ইনজামাম উল হকের ক্যাচটা? ওয়র্নেরই বলে বল পেরিয়ে চলে গেছে শার্প টপ এজে ডানদিকে পিছনের দিকে ঝাঁপিয়ে বল তুলে নিলেন ছাতুর শরবতে চুমুক দেওয়ার মতোই আরামে। দলে আসার পর থেকেই দ্বিতীয় স্লিপ তাঁর নাম লেখা ছিল। প্রথম স্লিপে মার্ক টেলর বা শ্যেন। দ্বিতীয় স্লিপে ফ্লপি হ্যাট পরে মার্ক। টেস্টে ক্যাচের বিশ্বরেকর্ডটা রাহুল দ্রাবিড় অনেক পরে ভাঙেন। কিন্তু স্টাইল বা খেলায় যেন বারবার উঠে এসেছে ডেভিড গাওয়ারের আয়নার অস্তিত্ব। যা গাওয়ার বাঁ হাতে করতেন তাই মার্ক করতেন ডান হাতে। অবশ্য ফিল্ডিংয়ে গাওয়ার কভার অঞ্চলে বাঘ ছিলেন। আর মার্ক ছিলেন স্লিপ অথবা মিড উইকেট।
স্টিভ ওয়াহ অবশ্য নিজের জন্য গালি বা এক্সট্রা কভারটাই রেখে দিয়েছিলেন। খেলা যখন ছাড়লেন স্টিভ, তখন পাঁচ নম্বরে সর্বাধিক সেঞ্চুরি এবং সর্বাধিক টেস্ট খেলার রেকর্ড। প্রায় এগারো হাজার রান। পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে নামা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বাধিকও। অথচ টেস্টে ১০০ উইকেট হয়নি তাঁর। চোটের কারণেই। এ-কথা যদি কেউ ১৯৮৫-৮৬-তে বলত, কেউ বিশ্বাস করত না যে, শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে স্টিভের ঈর্ষণীয় রেকর্ড হয়ে যাবে। আর জীবন বাজি রেখে ব্যাটিং? সর্বকালের সেরার নিরিখে স্টিভের পূর্বসূরি ছিলেন অ্যালান বর্ডার। কিন্তু স্টিভ একের-পর-এক ইনিংসে হয়তো তাঁর গুরুকেও মাত দিয়ে চলে গেছেন।
স্টিভ ওয়াহ আর মার্ক ওয়াহ। স্টাইলিশ না হয়েও ভরসাযোগ্য একজন, আর-একজন নন্দনশিল্পের প্রতিভূ। ঠিক যেন চক এবং চিজ অথবা বিজয়ার নিমকি এবং নারকেল নাড়ু। স্বাদে-রূপে আলাদা কিন্তু একই কর্মে নিয়োজিত।অমৃতলালের কাছে গেলে হয়তো বলতে পারতেন, চার মিনিটের হেরফেরে এমন ভিন্ন রূপ কীভাবে হতে পারে!
কিন্তু, নিজ নিজ ভূমিকাতেই দুজনে ক্রিকেট দেবতার উপাসনা করে গেছেন, একে অপরকে ছাপিয়ে না গিয়েই। অবশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার গাণ্ডিব কখনই তোলেননি উভয়েই। যে-যার নিজের আসনে আসীন থেকেই অপার বিস্ময় দান করে গেছেন ক্রিকেটপৃথিবীকে। খেলাটা যে শুধু খেলা নয়, সেটা লড়াই অথবা শিল্প। একই নামের চার মিনিটের এদিক-ওদিকের দুই বাল্যসঙ্গী সেটাই শিখিয়ে গেছেন আমাদের। আজ এত বছর পরেও এই কারণেই বারবার দুই ভাইকে মনে পড়ে যায়।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক