পেলে কখনো ইউরোপিয়ান ক্লাবে খেলেননি। ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময়ই কাটিয়েছেন নিজ দেশের ক্লাব সান্তোসের হয়ে। সে কারণে এ কালের বেশ কিছু ফুটবল অনুরাগীদের মধ্যে পেলের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রায়শই সন্দিহান প্রকাশ করতে দেখা যায়।
কিন্তু মূল ব্যাপারটা হচ্ছে, পেলের বয়স বিশের কোঠা পেরোনোর আগেই সে সময় তাঁকে নিয়ে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে রীতিমত কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছিল। পেলেকে দলে ভেড়ানোর দৌড়ে সে সময়ে ছিল বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বড় ক্লাব গুলো। কিন্তু দিনশেষে কোনো দলই তাঁকে দলভূক্ত করতে পারেনি। তাই ইউরোপিয়ান ফুটবলও আস্বাদন করা হয়নি পেলের।
ষাটের দশকেই পেলের শ্রেষ্ঠত্ব ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্বে। মাত্র ২১ বছরের মাঝেই ব্রাজিলের হয়ে জিতে ফেলেছিলেন দুটি বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের হয়ে অভিষেকের আগে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ফুটবলের বিস্ময় বালক হয়ে উঠেছিলেন।
সেই বালক যখন টানা দুই বিশ্বকাপ জিতলো তখন রীতিমত ফুটবলের মেগাস্টার বনে গিয়েছিলেন পেলে। আর এই দুই বিশ্বকাপ শিরোপার মাঝে আবার নিজের ক্লাব সান্তোসকে গড়ে তুলেছিলেন ব্রাজিলের একদম অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব হিসেবে। লিগ শিরোপা তো ছিলই, সাথে সে সময় টানা দুইবার কোপা লিবার্তাদোরেস জিতেছিল পেলের ক্লাব সান্তোস।
পেলের এমন ক্লাব আর জাতীয় দল- উভয় সাফল্যে মোহিত হয়ে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা। সময়টা ১৯৬৫ সালের একদম শেষ দিকের। তখন বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এনরিক লদেত। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেলার ঠিক আগে তিনি পেলেকে বার্সেলোনায় আনার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে আলোচনাও গড়িয়েছিল বহুদূর। এ চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য লদেত সহায়তা নিয়েছিলেন তাঁর ইতালিয়ান বন্ধু জেরার্ডো সানেলা।
বার্সা প্রেসিডেন্টের কথা মতো সানেলা সান্তোসের সাথে আলোচনাতেও বসেছিলেন। ১৯৬৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সান্তোসের কাছে পেলের ব্যাপারে প্রস্তাব পাঠান। এরপর দফায় দফায় আলোচনার পর পরের বছর ১৯৬৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে সান্তোস জানায়, পেলেকে সাইন করাতে হলে সান্তোসকে ১ মিলিয়ন ডলার আর পেলেকে ২ লক্ষ ডলার ট্রান্সফার ফি দিতে হবে। সে সময় এমন ট্রান্সফার ফি প্রায় অসাধ্যের মতো। মূলত পেলেকে নিজেদের ক্লাবে ধরে রাখতেই সান্তোস এমন অসম্ভব বাজারমূল্য নির্ধারণ করেছিল। তাই বার্সার পক্ষে আর পেলেকে দলে ভেড়ানো সম্ভব হয়নি।
তবে সে সময়ে সেই চড়ামূল্য ছাড়াও বার্সার জন্য আরেকটা বাঁধা ছিল। ১৯৫০ বিশ্বকাপে স্পেনের বাজে পারফরম্যান্সের কারণে স্প্যানিশ লিগ কর্তৃপক্ষ বিদেশি খেলোয়াড় সাইন করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সেই নিষেধাজ্ঞা ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।
তাই বার্সা চাইলেও সে সময়ে পেলেকে আনতে পারতো না। এমনি পেলের এমন চড়ামূল্যের কারণে তারা সে সময় আরেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার মাঞ্চাদো ডা সিলভাকে দলে ভেড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু ১৯৬৬ সালেও বিদেশি খেলোয়াড় সাইন করানোর ব্যাপারে সেই নিষেধাজ্ঞা চলমান ছিল। তাই পেলে তো নয়-ই, বার্সা কোনো বিদেশি খেলোয়াড়কে সে সময় দলে ভেড়াতে পারেনি।
পেলেকে বেশ ক’বার দলে ভেড়াতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে আরেক স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। পেলের ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে, তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার জন্য কোনো এক সময় নিজের ব্যাগও গুছিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ তা আর হয়নি। সান্তোসেই রয়ে গিয়েছিলেন পেলে।
এ নিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদের কাছ থেকে আমি বেশ ক’বার অফার পেয়েছি। কিন্তু আমি সান্তোসেই থেকেই গিয়েছিলাম। আর সে সময় সান্তোস ক্লাব ফুটবলে পাওয়ার হাউজ ছিল। আমি সেখানে ২০ বছর কাটিয়েছি। আমি সান্তোসেই বেশি খুশি ছিলাম। রিয়ালে যাইনি বলে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি যেখানে ছিলাম, সেটা নিয়েই গর্ব করি।’
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নন ব্রিটিশ খেলোয়াড় দেখা যেত না বললেই চলে। একমাত্র ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই ছিল, যারা বিদেশি খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতো। যদিও সেই সময়ে ইংল্যান্ডেরই তিন সেরা খেলোয়াড় ববি চার্লটন, জর্জ বেস্ট আর ড্যানিস ল’কে নিয়ে ম্যান ইউ রীতিমত ক্লাব ফুটবলে ভয়ংকর এক নাম।
তো সে সময় রেড ডেভিলদের কোচ ছিলেন স্যার ম্যাট বাসবি। তিনিই প্রথম পেলেকে ম্যান ইউতে আনার চেষ্টা করেন। আনঅফিশিয়াল একটা প্রস্তাবও পাঠিয়ে দেন পেলের কাছে। কিন্তু ইংলিশ ফুটবলে তখন পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার ফুটবলার ভেড়ানোর ব্যাপারে তেমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নীতি ছিল না।
আর সে সময়ে নন-ব্রিটিশ ফুটবলার ইংলিশ ক্লাবে ভেড়ানোর ঘটনাও ছিল খুবই কম। তাই ম্যান ইউ-ও সে প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে আর তেমন তৎপর ছিল না। এ জন্য পেলেকে আর দলে ভেড়ানো হয়নি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের।
এ নিয়ে ২০০৬ সালেই পেলে একবার ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, ‘১৯৬৮ সালে আমি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তখনকার সময়ে সেরা দল ছিল তারা। তারপরও আমি সে সময় তাদের ‘না’ করে দিয়েছিলাম। শুধু ম্যান ইউ নয়, সে সময় আমাকে প্রস্তাব দেওয়া সব দলগুলোকেই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।’
ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে পেলে প্রস্তাব পেয়েছিলেন ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের কাছ থেকেও। ১৯৬১ সালে জুভেন্টাসের জিওভানি আগনেলি পেলেকে কেনার জন্য সান্তোস প্রেসিডেন্টের কাছে এক মিলিয়ন ডলারের একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। একই সাথে তারা পেলেকে গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফিয়াটের শেয়ারও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পেলে সেই লোভনীয় অফারও সবিনয়ে সে সময় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই ওল্ড লেডিদের হয়ে আর খেলা হয়নি পেলের।
পেলের এমন সান্তোস প্রীতি অবশ্য সব সময়ই ছিল। অবসর পরবর্তী জীবনেও সান্তোসকে বুকে লালন করে গেছেন তিনি। সান্তোসকে নিয়ে নিজের আবেগের কথা জানিয়েছেন বারবার। ইউরোপিয়ান ক্লাব কিংবা দল বদল নিয়ে পেলে একবার একান্ত নিজস্ব একটি মতামত তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইদানিং দেখি দলবদল নিয়ে খুব মাতামাতি হয়। এবারের বছরে একজন এক দলে খেললো, পরের বছরে দেখি সে অন্য এক দলে চলে যাচ্ছে। আসলে ওরা টাকা ভালবাসে, ক্লাব না। আমি টাকা আর ক্লাবের মধ্যে ক্লাব বেছে নিয়েছিলাম। আমি সত্যিই সান্তোসে অনেক ভাল ছিলাম।’
তবে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারে পেলে আরেকটি ক্লাবের হয়েও খেলেছিলেন। আর সেই ক্লাবটা ছিল ভিনদেশী এক ক্লাব। নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষের পর পেলে সান্তোস ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। দুই দশমিক আট মিলিয়ন ডলারে তাকে কিনেছিল নিউইয়র্ক কসমস। যদিও কসমসের হয়ে প্রথম ৮ মাস খেলতে পারেননি পেলে। পরে অবশ্য এ দলটির হয়ে ৩৭ টি গোল করেছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, ঐ কসমসের হয়েই প্রিয় ক্লাব সান্তোসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন সর্বকালের সেরা এ ফুটবলার।