সর্বকালের সেরা অধিনায়ক কে?

ফুটবলে অধিনায়কের ভূমিকা কি? আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নামেন এবং হয়তো ম্যাচ শেষে বিজয়ী ট্রফিটা শুরুতে তাঁর হাতেই ওঠে। হকির অধিনায়কের ভাগ্যেও এমনটা ঘটে। টেনিসে ডেভিস কাপে অধিনায়কের ভূমিকা কেবলই খেলোয়াড় পছন্দ করাতেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে, টেস্ট ক্রিকেটে মাঠের সিদ্ধান্তটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অধিনায়ক নিজেই নিয়ে থাকেন। 

টস জিতে ব্যাটিং কিংবা বোলিং নেয়া, একাদশ নির্বাচন করা, ব্যাটিং কিংবা বোলিং অর্ডার ঠিক করা, ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্ত নেয়া কিংবা সংবাদ মাধ্যম সামলানোর মতো কাজগুলো ক্রিকেটে অধিনায়ককেই করতে হয়। কোনো সন্দেহ ছাড়াই তাই বলে দেয়া যায়, টেস্ট অধিনায়ককেই সকল ধরনের খেলাধুলার মাঝে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। 

অবধারিতভাবেই তখন প্রশ্নটা উঠে আসে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক কে? সর্বকালের সেরার প্রশ্নটা সব সময়ই বিতর্কিত। বিভিন্ন যুগের বিবেচনায় তুলনা করাটা হয়ে দাঁড়ায় দুঃসাধ্য। আসুন খানিকটা তথ্য উপাত্তের সাহায্যে সেরা নির্বাচনের চেষ্টা করা যাক। 

অধিনায়কদের প্রসঙ্গ আসলে সবার প্রথমে মনে পড়ে সাবেক প্রোটিয়া কাপ্তান গ্রায়েম স্মিথের কথা। স্মিথ সবচেয়ে বেশি ১০৯টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সর্বাধিক ৫৩ ম্যাচে জয়ের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ২৯ টেস্টে হেরেছেন। অন্যদিকে, অ্যালান বোর্ডার সর্বাধিক ৩৯ ড্র টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন।

তবে টেস্টে অধিনায়কত্ব করা ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ৭২% শতাংশ জয় পেয়েছেন স্টিভ ওয়াহ। তালিকার পরের দুই নামও দুইজন অজি কাপ্তানের, রিকি পন্টিং এবং স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও জয় পেয়েছেন ৬০% ম্যাচে। অন্যদিকে, ড্র করার দিক থেকে এগিয়ে আছেন ইংরেজ কাপ্তান মাইক গ্যাটিং, অধিনায়কত্ব করা ৬৯.৬% ম্যাচেই ড্র করেছে তাঁর দল। 

হারের কথা বিবেচনা করলে এই তালিকায় সবার উপরে আছেন জিম্বাবুয়ের কাপ্তান অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, প্রায় ৫৭% শতাংশ ম্যাচেই হেরেছেন তিনি। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই, সেই সময়ে জিম্বাবুয়ে তাঁদের অধিকাংশ ম্যাচেই হারের সম্মুখীন হতো। এই তালিকার পরের স্থানে আছেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক জেসন হোল্ডার, ৫৬.৮% ম্যাচেই হেরেছেন এই তারকা। 

এবারে খানিকটা গভীরে প্রবেশ করা যাক। প্রতিপক্ষের মাঠে পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বরাবরই কঠিন কাজ। তবে অ্যাওয়ে টেস্টে জয়ের তালিকাতেও সবার উপরেই আছেন স্টিভ ওয়াহ, অধিনায়কত্ব করা ২৮ অ্যাওয়ে টেস্টের মধ্যে ১৯ টেস্টেই জয় পেয়েছেন তিনি। সমান সংখ্যক অ্যাওয়ে জয় আছে রিকি পন্টিংয়েরও, কিন্তু সেজন্য তাঁকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে ৩৮ ম্যাচ।

তালিকার পরের স্থানগুলোতে আছেন মিসবাহ উল হক, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, বিরাট কোহলি। ঘরের মাঠে টেস্ট জয়ের হিসেবে আবার এগিয়ে আছেন এই ভারতীয়, ৩১ টেস্টের মাঝে ২৪ টেস্টেই জয় তুলে নিয়েছেন তিনি। পিছিয়ে নেই স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংও, ঘরের মাঠে তাঁরা যথাক্রমে ২২ এবং ২৯ টেস্টে জয় পেয়েছেন। 

এবারে আসা যাক ভাগ্যের পরীক্ষায়, টস জয়ের পরীক্ষা। ক্রিকেটে বিভিন্ন সময়েই টসে জয় বাড়িয়ে দেয় ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা। টস জেতার অবশ্য সবার উপরে আছেন অখ্যাত এক নাম, লিন্ডসে হ্যাসেট। নিজের প্রতি চার টেস্টের মাঝে তিন টেস্টেই টস জিতেছেন তিনি।

গ্যারি সোবার্সও তাঁর অধিনায়কত্ব করা ৩৯ টেস্টের মাঝে ৬৯% ম্যাচে টস জিতেছেন। পরের দুই স্থানে আছেন সনাৎ জয়াসুরিয়া এবং পিটার মে। টস হারার দিক থেকে সবার আগে আছেন ইংরেজ ব্যাটার লেন হাটন, ২৩ টেস্টের মাঝে মাত্র সাত টেস্টে টস জিতেছেন তিনি। অন্যদিকে, টস জিতে ফিল্ডিং নেবার দিক থেকে সবার আগে ক্যারিবীয় কাপ্তান ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট, ১১ বার টস জিতে তিনি নয় ম্যাচেই আগে ফিল্ডিং নিয়েছেন।

তবে টেস্ট জয়টা কেবলই অধিনায়ক কিংবা টস জেতার উপর নির্ভর করে না, বরং দলের শক্তিমত্তাও প্রভাব বিস্তার করে। এইক্ষেত্রে অধিনায়কদের মাঝে তুলনা করতে আমরা ব্যবহার করবো পারফরম্যান্স ইনডেক্স, অর্থাৎ জয় পাওয়া উচিত এমন ম্যাচের হার। যেমন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের কথাই ধরা যাক, ২৪ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫ টেস্টে জয়ের পাশাপাশি ছয় টেস্টে ড্র এবং তিনটিতে হেরেছেন তিনি।

তাঁর পারফরম্যান্স ইনডেক্স গিয়ে দাঁড়ায় ১.৩৬। অন্যদিকে, তাঁর দলের শক্তিমত্তা অনুযায়ী ইনডেক্স হওয়ার কথা ছিল ১.১২। অর্থাৎ তাঁর অধিনায়কত্ব কিংবা অন্য কোনো প্রভাবে তাঁর দল ওভার পারফরম্যান্স দেখিয়েছে ১.২২। ইয়ান চ্যাপেলও পিছিয়ে নন তাঁর চাইতে, তাঁর ক্ষেত্রে অনুপাতটা ১.১৮। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সাবেক কাপ্তান আবদুল হাফিজ কারদার, তাঁর ওভারপারফরম্যান্স ইনডেক্স ১.১৪। 

তবে কেবল অধিনায়কত্ব নয়, বরং তাঁদের পারফরম্যান্সও প্রভাব ফেলে দলের ফলাফলের উপর। এই ক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হল বোলিং অলরাউন্ডাররা সকলেই অধিনায়কত্ব পাবার পর তাঁদের ব্যাটিংয়ে উন্নতি এসেছে। রে ইলিংওররথ, হিথ স্ট্রিক, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি সকলেই ব্যাটিংয়ে উন্নতি করেছেন অধিনায়কত্ব পাবার পর। দেখা গেছে, তাঁদের মাঝে দায়িত্ববোধ বেড়েছে এবং ব্যাটিং অর্ডারে উপরে উঠে এসেছেন। সৌরভ গাঙ্গুলির ক্ষেত্রে অবশ্য উল্টোটা ঘটেছে, অধিনায়ক হবার পর তাঁর ব্যাটিংয়ের গ্রাফটা ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে। 

অন্যদিকে, তাঁদের বোলিংয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টোটা। হিথ স্ট্রিক, ইমরান খান, ড্যারেন স্যামি প্রত্যেকের বোলিংয়ের অবনতি ঘটেছে। অন্যদিকে, রিচি বেনো এবং গ্যারি সোবার্স দুজনেরই বোলিংয়ে উন্নতি এসেছে এই সময়টাতে।  

এবারে আসা যাক, ব্যাট কিংবা বল দুই ডিপার্ট্মেন্টেই অধিনায়কদের ভূমিকা নিয়ে। এই তালিকায় সবার উপরে আছেন জেসন হোল্ডার, ব্রিজটাউনে লংকানদের বিপক্ষে হারা টেস্টে দলের মোট পারফরম্যান্সের ৪০% ভূমিকা ছিল তাঁর। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ৩৭% নিয়ে আছেন সাবেক ইংরেজ অধিনায়ক ডেনিস অ্যাটকিনসন। ১৯৬৬ সালে লিডসে গ্যারি সোবার্সের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স, কিংবা ভেট্টোরির চট্টগ্রাম পারফরম্যান্সও আছে এই তালিকায়। 

এবারে আসা যাক, দলকে বদলে দিতে কিংবা খারাপ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অধিনায়কদের ভূমিকা নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে প্রায় খাদের কিনারা থেকে ম্যাচ বাঁচিয়ে তুলেছে অধিনায়কের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। এই তালিকায় সবার উপরে উঠে আসে ২০২২ সালের রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের কথা, ব্যাটিং স্বর্গ বুঝতে পেরে ইংরেজ অধিনায়ক বেন স্টোকস শুরুতেই সিদ্ধান্ত নেন মারকুটে ব্যাটিং করার।

ডেড পিচে পারফেক্ট সময়ে ইনিংস ঘোষণা করেছেন, বোলারদের পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে অলআউট করার। আপাত-নিরীহ ড্র এক টেস্ট থেকে তাই জয় নিয়ে ফিরেছে ইংল্যান্ড স্টোকসের এই এক সিদ্ধান্তে। 

এছাড়া ডন ব্র্যাডম্যানের সেই বিখ্যাত ভেজা উইকেটে ব্যাটিং অর্ডার উল্টো করে দেবার ঘটনা তো সবারই জানা। 

তবে বিভিন্ন সময়ে এমন সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে দলের জন্য, সেক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই সমালোচনার শিকার হয়েছেন অধিনায়ক নিজে। যেমন ২০০৯ সালে অ্যান্টিগা টেস্টে ইংরেজ অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষকে ফলো অন করাননি। শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের পুড়তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ উইকেট তুলতে না পারার আক্ষেপে। 

গ্রায়েম স্মিথের ঘটনা আবার উল্টো। সিডনীতে অজিদের বিপক্ষে জয়ের জন্য ছুটতে গিয়ে তৃতীয় ইনিংসে দ্রুতই ডিক্লেয়ার করে দেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ভুল প্রমাণিত হয় পরের দিনেই, তাঁদের দেয়া ২৮৮ রানের লক্ষ্য অজিরা পেরিয়ে গিয়েছিল মাত্র দুই উইকেট হারিয়ে। প্রোটিয়া বোলাররা সেদিন বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারেননি। 

শেষভাগে এসে মনে প্রশ্নটা উঁকি দেয়, আচ্ছা বিশ্বসেরা এক একাদশের নেতৃত্ব দেবেন কে? এক লহমায় মনে পড়ে স্টিভ ওয়াহ, ক্লাইভ লয়েড, রিকি পন্টিং, স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের নাম। ওয়াহ এবং পন্টিং নিজেদের দল নিয়ে দুর্দান্ত করেছেন, তবে প্রতিপক্ষের মাঠে ওয়াহ খানিকটা এগিয়ে থাকবেন উত্তরসূরির চাইতে।

চ্যাপেল অবশ্য খুব শক্তিশালী এক দল পাননি, তবে সীমিত শক্তির দল নিয়েই জানান দিয়েছেন নিজেদের সামর্থ্যের। সৌরভ গাঙ্গুলি তো রীতিমত ভারতকে পরিণত করেছিলেন ডার্ক হর্সে। ক্লাইভ লয়েডের অবশ্য দুর্নাম ছিল স্পিনারদের প্রতি বেশি ভরসা করার। 

তবে সবকিছু একটা নামের দিকেই ইঙ্গিত করে – স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। পারফরম্যান্স ইনডেক্স, নিজের অনবদ্য ব্যাটিং দক্ষতার পাশাপাশি ট্যাকটিশিয়ান হিসেবেও তিনি অতুলনীয়। এছাড়া দলের পেস এবং স্পিন দুই ডিপার্ট্মেন্টের বোলারদের মাঝেই সমন্বয় ঘটাতে জানতেন। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে, একমাত্র স্যার ডন ব্র্যাডম্যানেরই যে সর্বকালের সেরা একাদশে জায়গাটা পাকা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link