লারকানা শহরটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যায় ঐতিহাসিক সিন্ধু নদ। বলা হয় পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের এই লারকানাতেই গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদাড়ো শহর। তবে এই অঞ্চলের গ্রাম গুলোতে এখনো পৌছায়নি আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া।
তবে ক্রিকেটকে তো আর সভ্যতার বেড়া তার রুখতে পারেনা। এই লারকানার এক অজোপাড়া গ্রাম থেকেই পাকিস্তান দলে পদার্পন করছেন দীর্ঘাকায় এক পেসার, শাহনেওয়াজ ধানি।
ধানির গ্রামটিতে ঠিক সত্যিকারের ক্রিকেটটা খেলার কোনো সুযোগ ছিল না। সত্যিকারের ক্রিকেট বলছি এই জন্য যে আর দশটা গ্রামের মত টেপ টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলা হলেও কাঠের বলে ক্রিকেট খেলার কোনো সুযোগ এই গ্রামটাতে ছিল না।
তবে, ক্রিকেটের জোয়ার ঠিকই ছিল এখানে। গ্রামের যেই দুই একটা বাড়িতে টিভি সেখানে দল বল নিয়ে ভীড় করে ক্রিকেট খেলা দেখতেন ধানিরা। এই দেখতে দেখতে ১০ বছর বয়সে বন্ধুদের সাথে টেপ টেনিস খেলা শুরু করেন তিনি।
একটা সময় খেলাটার নেশা ধরে যায় তাঁর। সারাদিন এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। তবে তাঁর ছেলের ক্রিকেট নিয়ে এই মাতামাতি খুব একটা পছন্দ করতেন না ধানির বাবা। আর সব বাবার মতই চাইতেন ছেলে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করবে। তবে পরবর্তীতে ধানির বাবার একটি সিদ্ধান্তই ধানির জীবন বদলে দেয়। যেই সিদ্ধান্তের জোরে আজ ধানি পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায়।
অথচ ২০১৬ সাল অবধি শাহনেওয়াজ ধানি কখনো কাঠের বল ছুঁয়েও দেখেননি। তবে ২০১৬ সালেই আঞ্চলিক যুব দলের এক কর্তা তাঁদের গ্রামে আসেন। এই কর্তা আবার ছিলেন ধানির বাবার বাল্যকালের বন্ধু। উনি গ্রামে আসা উপলক্ষে একটি টেপ টেনিস ম্যাচেরও আয়োজন করে গ্রামবাসী।
সেদিন ধানির বাবা তাঁকে বলেছিল, ‘দেখি পারলে আমার বন্ধুর বিপক্ষে খেলে দেখাও।’ সেদিন বোধহয় গ্রামের মাঠে নিজের সেরাটাই নিঙরে দিয়েছিলেন ধানি। তাঁর বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়ে যুব দলের সেই কর্তা তাঁকে বলেছিল শহরে গিয়ে কাঠের খেলবে কিনা।
ধানির খুশি সেদিন আর কে দেখে। বাবার দোয়া নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে সেদিন লারকানা শহরে ট্রায়াল দিতে চলে যান। তবে সেই ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন বন্ধুর থেকে জুতা ধার করে। ট্রায়ালে সিলেক্ট হয়ে সেবছরই সুযোগ পান লারাকন অনুর্ধব-১৯ দলে। এই দলটির হয়ে দুদিনের একটি আন্ত:জেলা ম্যাচে প্রথম কাঠের বল হাতে খেলতে নামেন শাহনেওয়াজ ধানি। প্রথম ম্যাচেই তুলে নেন ৯ উইকেট।
দুই বছর আঞ্চলিক ক্রিকেট খেলার পর ২০১৯ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। সেবছরে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিন ম্যাচ খেনে ৯ উইকেট পান তিনি। এই তিন ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়েই সিন্ধু প্রদেশের হয়ে খেলার সুযোগ পান এই পেসার। ২০১৯ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ পাঞ্জাবের বিপক্ষে সেই ম্যাচে ১ টি উইকেট ও পান তিনি। সেদিন তাঁর বোলিং দেখে সারফারাজ খান সহ আরো সিনিয়র ক্রিকেটাররা বেশ বাহবা দিয়েছিলেন তাঁকে।
তবে ২০২০-২১ সিজনে বেশ সিন্ধু প্রদেশের হয়ে নিজের সেরাটা দেন এই পেসার। জাতীয় টি-টোয়েন্টি কাপে ৪ ম্যাচে নেন ৬ উইকেট। তারপর কুয়াইদ-ই-আজম ট্রফিতে সাতটি টেস্ট ম্যাচে নেন মোট ২৬ উইকেট।
শাহনেওয়াজের এই পারফর্মেন্সের পুরষ্কার খুব তাড়াতাড়িই পান এই ক্রিকেটার। এবছর তিনি সু্যোগ পান পাকিস্তান সুপার লিগে (পিএসএল)। পিএসএলে মুলতান সুলতান’স এর হয়ে এবার চারটি ম্যাচ খেলেন তিনি। চার ম্যাচেই ৯ উইকেট নিয়ে আবারো ঝড় তুলেন এই পেসার।
সবমিলিয়ে পাকিস্তান জাতীয় দলে ঢোকাটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল ধানির জন্য। এপ্রিলে পাকিস্তানের দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ে সফরের জন্য টেস্ট দলেও ডাক পান এই ক্রিকেটার। হয়তো সব ঠিক থাকলে কোনো ম্যাচে পাকিস্তানের হয়ে খেলার স্বপ্নও পূরন হবে তাঁর।
কী অদ্ভুত ভাবে ২০১৬ সালে এক গ্রামে টেপ টেনিস খেলা বেড়ানো ছেলেটা এখন কাঠের বলে ঝড় তুলেন। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এখন তিনি পাকিস্তান জাতীয় দলের দাড়প্রান্তে।