আমাদের ছোটবেলার সবচেয়ে পছন্দের কাজটা বোধহয় ছিল রূপকথার গল্প শোনা। বেড়ে ওঠার সময়টা কেটেছে রাজা-রানী, রাক্ষসপুরীর গল্প শুনে। প্রিয় কাজটা ছিল রূপকথার গল্পের কল্পনায় হারিয়ে যাওয়া। নিজের স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা। কিন্তু হায়! বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের সেই স্বপ্নগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
জীবনের একটা পর্যায়ে এসে আমরা আর সেই রূপকথার নায়ককে খুঁজে পাই না। বরং খুঁজতে থাকি বাস্তব জীবনের নায়ককে, রক্তমাংসে গড়া মানুষকে। নব্বইয়ের দশকের মানুষজনের জন্য হিসাবটা আবার সোজা। তাঁদের রূপকথা আর বাস্তবের নায়কের মাঝে তেমন পার্থক্য নেই। লাতিনের দুই আসল নায়কে মত্ত সবাই। তাঁরা হলে দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা এবং এডসন আরান্তেস দো নসিমেন্তো ‘পেলে’।
দুজনেই ফুটবল খেলতেন, দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশ এবং ক্লাবের হয়ে অজস্র ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে ফুটবলারদের এক দীর্ঘ তালিকা পাওয়া যাবে যারা কিনা ট্রফি সংখ্যায় পেলে বা ম্যারাডোনার চাইতে কোনো অংশে কম নন। তাহলে কেন পেলে-ম্যারাডোনাই অবিনশ্বর হয়ে থেকে যান মানুষের হৃদয়ে, অন্যদের কমতিটা কোথায় ছিল।
ম্যারাডোনাতে মানুষ পেয়েছিল আপন জীবনের চিত্রায়ন। ফুটবল মাঠে যেন কবিতা লিখতেন, সবুজ গালিতায় ছন্দ তুলে এগিয়ে যেতেন সবকিছু পেছনে ফেলে। আবার তিনি ফেরেশতাও নন, মূহুর্তের আবশ্যকতায় হাত দিয়ে গোল করে। হ্যান্ড অফ গডের নাম করে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেন। মাঠের বাইরের জীবনটা তাঁর আরো রঙিন। জীবনভর নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেছেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই করেননি, আবার কখনো সখ্যতা গড়েছেন ইতালিয়ান মাফিয়ার সাথে।
অন্যদিকে, পেলে ছিলেন ম্যারাডোনার সম্পূর্ণ আলাদা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জিতে আট বছর আগে বাবাকে দেয়া কথা রেখেছেন। পরবর্তীতে আরো দুটি বিশ্বকাপ জিতে নিজেকে নিয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটাও কম রঙিন নয়, তবে কখনো লাগাম ছাড়া হতে দেননি। নিজের সম্মানের জায়গাটা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেননি। ফুটবল মাঠে যা কিছু জেতা সম্ভব সবই নিজের করে নিয়েছেন, ফুটবলের প্রথম বৈশ্বিক তারকা এমনকি যুদ্ধও থামিয়ে দিয়েছিলেন একবার। আর সবকিছুই তিনি করেছেন মুখে হাসি নিয়েই।
ম্যারাডোনা আর পেলে দুজনেই ছিলেন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। অথচ তাঁদের গল্পটা কোনো অংশেই রূপকথার সেই গল্পের চাইতে কম রোমাঞ্চকর না। পৃথিবীর বড় একটা অংশের কাছে পেলে-ম্যারাডোনার গল্পটা জীবন্ত ছিল বহু সময় ধরে।
২৫ নভেম্বর, ২০২০ – এদিনই প্রথমবারের মতো ধাক্কা খায় গোটা বিশ্ব। মাত্র ৬০ বছর বয়সে লুজনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন দুই জাদুকরের একজন ম্যারাডোনা। গোটা বিশ্বজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। শোকাতুর পরিবেশে সান্ত্বনা দেবার জন্যে সেদিন একজন ছিলেন, পেলে।
পেলে এবং ম্যারাডোনা দুজনেই মাঠের বাইরে অম্লমধুর এক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। দুজনেই একে অন্যের ফুটবলশৈলীর প্রশংসা করেছেন, আবার একই সাথে বুঝিয়ে দিতে ছাড়েননি দিনশেষে তিনিই সেরা। ম্যারাডোনার স্মরণে পেলে সেদিন লিখেছিলেন, ‘আমি কাছের একজন বন্ধুকে হারিয়েছি আর পৃথিবী হারিয়েছে একজন কিংবদন্তিকে। অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু এই মূহুর্তে ঈশ্বর তাঁর পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দান করুক। আশা রাখি একদিন হয়তো আমরা দুজনে আকাশে ফুটবল খেলবো।’
২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ – দুই বছরের কিছু সময় বাদে কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন পেলে। পৃথিবীর সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করে যাত্রা করেন অনন্ত মহাকালে আগে থেকেই থাকা বন্ধুর উদ্দেশ্যে।
পেলে এবং ম্যারাডোনা দুজনেরই চলে যাবার পর পৃথিবী হারিয়েছে তাঁর দুই আইকনকে আর মানুষ হারিয়েছে তাঁর জীবনের নায়ককে। কিন্তু রূপকথার গল্পের মতোই পেলে-ম্যারাডোনা রয়ে যাবেন জীবন্ত হয়ে, তাঁদের কীর্তি রটে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। রাতে যদি কখনো আকাশের তারাদের রিও ডি জেনিরো আর বুয়েন্স আয়ার্সের দিকে ছোটাছুটি করতে দেখো, তবে ধরে নিও ওপারে গিয়ে পেলে তাঁর কথা রেখেছেন।