মহাবিশ্ব তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের সামনে নতজানু হতে বাধ্য

ম্যাচ সিল না করে ক্রিজ ছাড়তে নেই। কোহলি তখনও আজকের চাপ দাড়ির বিরাট হননি। গোলগাল। হাতে আসেনি উপমহাদেশের জহরমানি এম আর এফ ব্যাট। নাইকির টিক দেওয়া পাতলা ব্লেডের ব্যাটে বিরাট সেদিন খেলাটা শুরু করেছিলেন যখন,তখন শচীন-শেবাগ আউট, টার্গেট ৩১৮।

ক্রিসমাসের আগের রাত। খেলা শেষ হয়ে গেছে। ইডেনের কমেন্ট্রি বক্সের সামনের কাচ বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কুয়াশা। খুব সম্ভবত সম্বরণ ব্যানার্জি- বলছেন, কীভাবে খেলা শেষ করে বেরোতে হয় দেখিয়ে দিয়েছেন গৌতম গম্ভীর। বিরাট কোহলিকে শিখতে হবে।

ম্যাচ সিল না করে ক্রিজ ছাড়তে নেই। কোহলি তখনও আজকের চাপ দাড়ির বিরাট হননি। গোলগাল। হাতে আসেনি উপমহাদেশের জহরমানি এম আর এফ ব্যাট। নাইকির টিক দেওয়া পাতলা ব্লেডের ব্যাটে বিরাট সেদিন খেলাটা শুরু করেছিলেন যখন,তখন শচীন-শেবাগ আউট, টার্গেট ৩১৮।

গৌতম আর বিরাট খেললেন ২২৪ রানের পার্টনারশিপ। কিন্তু ম্যাচটা শেষ না করেই, সেঞ্চুরি পেরিয়ে বিরাট একটা ক্যাচ তুলে দিলেন বেখাপ্পা। আউট। দেড়শো রানে অপরাজিত থেকে শেষ অবধি ম্যাচটা জিতয়ে ফেরেন গৌতম গম্ভীর। মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোনের যুগে, সেলিব্রেশনে আজকের মতো ফ্লাশলাইটের আলো জ্বালানোর চল ছিল না।

কলকাতার কনকনে শীতে গোটা ইডেন উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিল গৌতিকে। সচিন-সৌরভ জমানার পরবর্তী ভয়েড স্পেসে, যিনি দেশের টপ অর্ডার ব্যাটিং-এর অন্যতম সফল ব্যাট। দেড় দশক পর এই ইডেনে বিরাট নিরানব্বই রানে স্ট্রাইকিং এন্ডে আসতেই গোটা স্টেডিয়ামে জ্বলে উঠল ফ্লাশলাইট।

রাজার সিংহাসনে বসার আগে, ইডেন তার স্বকীয় মেজাজে। বিরাট কোহলি সিঙ্গেল নিলেন। সেঞ্চুরি হল। উনপঞ্চাশতম। এদেশে তাঁর সমতূল্য স্ট্যাটের অধিকারী একমাত্র শচীন। সেদিনের সেঞ্চুরি আর এবারের শচীনকে ছুঁয়ে ফেলা উনপঞ্চাশতম সেঞ্চুরির মাঝে চোদ্দটা বছর।

ফর্টিন ইয়ার্স; আর এই চোদ্দ বছরে কোহলি হয়ে উঠেছেন বিরাট। তাঁর প্রতি নাইন্টিজ কিডদের প্রাথমিক ভালবাসা, আলুথালু নস্ট্যালজিয়া কাজ না করলেও, এ মহাবিশ্বের প্রতিটি কাঁকড় তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের সামনে নতজানু হতে বাধ্য!

তবে, এই বিরাটগাথার বাইরে, কোহলি থেকে বিরাট হয়ে ওঠার জার্নিতে, তিনি যা আয়ত্ব করেছেন তা হল ম্যাচ সিল না করে ক্রিজ না ছাড়ার অদম্য ক্ষমতা। আজ, ইডেনের পিচে, বল থমকে আসার পিচে, যেখানে ভারতের নেসেসিটি ছিল একজন অ্যাঙ্কর যিনি শেষ অবধি টিকে থেকে একটা দিক ধরে রাখবেন, সেই পিচে, কিছুটা আউট অফ টাচ বিরাট কোহলি স্রেফ ঐশ্বরিক অধ্যাবসায় আর প্রতিভার মিশেলে আয়ত্ব করা ক্ষমতার জোরে শেষ বল অবধি টিকে রইলেন।

এই পিচে, কেশব মহারাজের দশ ওভার, মিডল ফেজে বিরাট না থাকলে ভারতের স্কোরবোর্ড খুব দৃষ্টিনন্দন হত না। কিন্তু হয়েছে- কারণ চোদ্দ বছর আগের গোলগাল কোহলি, সেদিন সুরাজ রণদীপের বলে যে ক্যাচটা তুলে ফিরে গিয়েছিলেন সেই ভুল তিনি আর করেন না।

ইডেনে সেঞ্চুরির পর বিরাট একবার ক্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে ছিলেন উইকেটের দিকে। সম্বিতদা একবার লিখেছিল, ব্যাট কখনও আর ব্যাট থাকে না, সে হাতেরই অংশ হয়ে যায়- ক্রিজের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত অবধি এই টান, স্টাম্প মার্ক-কাঁকড়-ধুলো-পপিং ক্রিজ-ক্র‍্যাক আসলে তাঁর আশ্রয় হয়ে গেছে এই চোদ্দ বছরে।

ম্যাচ সিল না করে, তিনি কিছুতেই ক্রিজ ছেড়ে যাবেন না আর, কোনওদিন। সেদিনের প্রথম সেঞ্চুরি করা কোহলি থেকে এবারের উনপঞ্চাশ সেঞ্চুরির মালিক বিরাট হয়ে ওঠার দেড় দশকে এই শিক্ষাই বোধ করি তাঁর শ্রেষ্ঠ অর্জন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...