২০১০ সাল।
মহারাষ্ট্রের মফস্বল শ্রীরামপুরের এক ফটোগ্রাফি স্টুডিও মালিকের ছেলে একবিংশ শতকের আগমনের সাথে সাথেই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সংস্কারক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির হাত ধরে ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলে প্রতিষ্ঠা পেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্রায় এক দশক পেরিয়েও শেখার ইচ্ছা হারাননি। তিনি জহির খান।
আরো পড়ুন
- নিজেকে ‘জাহির’ না করে
- সংগ্রামী-ধুরন্ধর-সব্যসাচী
- জ্যাক দ্য রিপার
- যারা স্টেপ আউট করতে ভয় পাও
- অনুকরণীয় বোলিং অ্যাকশন
বা-হাতি এই ফাস্ট বোলারটি লক্ষ্য করলেন যে দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট একটা রহস্যময় ডেলিভারি করছেন – স্লোয়ার বল করছেন কিন্তু বলটা হাতের পিছন দিক দিয়ে ছাড়ার পরিবর্তে সাধারণ ডেলিভারির ভঙ্গিমায় একই গতিতে হাত ঘুরিয়ে আঙুলের গাঁট দিয়ে বলটাকে ঠেলে দিচ্ছেন। ব্যাটসম্যান বোকা বনে যাচ্ছে।
ডেলিভারিটা ভারতীয় পেসার জহির খানের খুব বেশি মনে ধরলো। প্র্যাকটিস করতে শুরু করলেন নিজের মত করে।
সে বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বলটা প্রথমবার ব্যবহার করলেন। কিন্তু মারকুটে অজি ওপেনার ডেভিড বলটিকে লং অফের উপর দিয়ে গ্যালারিতে আছড়ে ফেললেন।
জহির খান বুঝলেন এখনো পুরোটা রপ্ত হয়নি। চললো আরো বেশি বেশি করে প্র্যাকটিস।
কাট টু ২০১১ সাল।
ডেলিভারিটা নিখুঁতভাবে রপ্ত করার পরেও সামনে দেশের মাঠে অনুষ্ঠিত হতে চলা আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে চমক হিসাবে ব্যবহার করবেন বলে ছয় মাস কোনো ম্যাচে ডেলিভারিটা করা থেকে বিরত থাকলেন।
টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর প্রথম ব্যবহার করলেন গ্রূপ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের ডেভন স্মিথের তিনটে স্টাম্পকে মাটিতে উপড়ে ফেলতে।
তারপর এলো টুর্নামেন্টের অন্যতম হাই ভোল্টেজ ম্যাচ – আহমেদাবাদের মোতেরাতে বিশ্বজয়ী অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন ক্যাঙ্গারু বাহিনীর বিরূদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। অজি বাহিনী ৩ উইকেটের বিনিময়ে ১৫০ রান করে ভারতীয় বোলিংয়ের উপর দিয়ে স্টিম রোলার চালিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। ক্রিজে মিস্টার ক্রিকেট খ্যাত মাইকেল হাসি হাত খোলার অপেক্ষায়। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি তার বোলিং বিভাগের বিশ্বস্ত সেনাপতির হাতে বল তুলে দিলেন।
জহির খান প্রয়োগ করলেন তার মোক্ষম অস্ত্র ‘নাকল স্লোয়ার’। বলটা মাইক হাসির ব্যাট ও প্যাডের ফাঁক গলে স্টাম্প উড়িয়ে দিল। মাইকেল ক্লার্কদের ৩০০ রানের টার্গেট খাড়া করার স্বপ্নকে স্বপ্নই রেখে দিয়ে মাত্র ২৬০ রানে বেঁধে রাখলো।
দশ ওভার বল করে ৫৩ রানের বিনিময়ে সংগৃহীত ২ উইকেট – পরিসংখ্যান কোনোদিন বলবে না যে ওই ৬০ টি বলের মধ্যে একটি বল ছিল দীর্ঘ আঠাশ বছর পর ভারতের বিশ্বজয়ের পথে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারি।
পরিসংখ্যান বলবে না যে পেস বোলারের আকালের এই দেশে কিংবদন্তি কপিল দেবের পর একমাত্র বিশ্বমানের পেস বোলারটি তার দীর্ঘ কেরিয়ারে বারেবারে প্রমান করেছেন যে পেস বোলার মানেই শুধু গতি, আগ্রাসন – নয়, বরং সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিখুঁত হওয়ার খিদে সর্বোপরি মস্তিস্কের সুব্যবহার আবশ্যক।
তাই তো ক্রিকেটের ঈশ্বর শচীন রমেশ টেন্ডুলকার এই জহির খান সম্পর্কে বলেন, ‘ও এমন একজন বোলার যে ব্যাটসম্যানদের ভাবতে বাধ্য করতো।’