স্যুইং বিষের বিনি অধ্যায়

শুরুতেই ক্ল্যারিফাই করে দেই – লেখাটা স্যার রিচার্ড হ্যাডলি বা ওয়াসিম আকরামকে নিয়ে নয়। উল্টে এমন একজনকে নিয়ে যার নাম একটু আগে উল্লেখ করা দুজনের পাশে রাখলে বোদ্ধারা মার মার করে তেড়ে আসবেন। তবে কিনা একটা বিশ্বকাপে ১৮টি উইকেট হ্যাডলিরও নেই।

আকরামের আছে তবে তার দুটো ম্যাচ বেশি লেগেছিল অতগুলো উইকেট পেতে। উইকেট পিছু রানও সামান্য বেশি দিয়েছিলেন। পুরনো দিনের ক্রিকেট প্রেমী হয়ত এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছেন। ঠিক, রজার বিনির কথাই বলছি।

১৯৮৩ নামের চলচ্চিত্র দেখার সময় প্রথম জানলাম যে বিশ্বকাপ চলাকালিন রজার বিনির সঙ্গে অধিনায়ক কপিলের সামান্য মনোমালিন্য হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় বা তার পরে এর বিষয়ে কোথাও কোনও খবর বেরিয়েছিল বলে মনে করতে পারছি না।

অবশ্য পারার কথাও নয়। চিরকালই বিনি লো প্রোফাইল রেখে চলতে ভালোবাসেন। এমন কি আজও ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে রজার বিনির অবদান নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। অথচ হওয়া উচিৎ। ৮ ম্যাচে ১৮ উইকেট – যথেষ্ট উঁচুমানের পারফর্মেন্স।

সেই বিশ্বকাপের তার চেয়ে বেশি উইকেট কোন বোলার পায় নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ভিভ এবং লয়েডের এবং ফাইনালে আবার লয়েডের উইকেট নেন বিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কার্যত নক আউট ম্যাচে চার উইকেট নিয়ে ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হন। এটি তার একদিনের ক্রিকেটে একমাত্র ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার।

অবশ্য বিনি যে ইংল্যান্ডে সফল হবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এক তো জন্মসুত্রেই তার মধ্যে ইংরেজ রক্ত রয়েছে। তার ওপর তার বোলিং ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার পক্ষে আদর্শ। উইকেটের দুই দিকেই ছোট ছোট স্যুইং এবং গতির হেরফের – ইংল্যান্ডের পিচে এ বস্তু সামলানো খুব একটা সহজ কাজ নয় (আকাশে একটু মেঘ থাকলে তো কথাই নেই)।

পরবর্তী কালে হেডিংলেতেও ভারতের টেস্ট জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন বিনি, ম্যাচে মোট ৭ উইকেট নিয়ে তিনি ভারতের জয়ের পথ প্রশস্ত করেন। এছাড়াও পাকিস্তানের পিরুদ্ধে ১৯৮৭র ইডেন টেস্টে একসময় বিনির স্পেল ভারতের জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিল। তৃতীয় দিনের বিকেলে গঙ্গার বাতাসকে কাজে লাগিয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন বিনি।

একদিনের ম্যাচে বিশ্বকাপ জয় ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জয়ে বিনির বড় অবদান ছিল। ১৯৮৫ সালে বেন্সন এন্ড হেজেস কাপে চারটি ম্যাচ খেলে ১৩.৬৭ গড়ে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন। সেই টুর্নামেন্টে ভারতের হয়ে সবচেয়ে ভালো বোলিং গড় তারই ছিল।

যদিও একদিনের ম্যাচে খুব বেশি কার্যকারী ইনিংস বিনি খেলেন নি, কিন্তু টেস্টে তার খান পাঁচেক হাফ সেঞ্চুরি আছে। সাধারণত ছয় থেকে নয়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করত তার ব্যাটিং অর্ডার, যদিও তিনি ওপেন অব্দি করেছেন। সুতরাং তাঁকে অলরাউন্ডার বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়।

কপিল, মহিন্দার, বিনি এবং মদনলাল – এতগুলো অলরাউন্ডার যে দলে থাকবে তার ব্যাটিঙের গভীরতা সহজেই অনুমেয়। সেই সঙ্গে এই চারজনের উপস্থিতি এনে দিয়েছিল বোলিং ইউনিট হিসেবে অসাধারণ বৈচিত্র কারণ এরা প্রত্যেকের বল করার ধরন একে অপরের চেয়ে আলাদা ছিল – কি গতিতে, কি স্যুইং-এ। সেই সঙ্গে স্পিনও ছিল।

কখনও শাস্ত্রী, কখনও বা আজাদ। এই বৈচিত্র সামলাতে যে তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানেরাও হিমসিম খাবেন তাতে খুব বেশি আশ্চর্যের কী আছে? বিশেষ করে ইংল্যান্ডে?

সবাই রবি শাস্ত্রীকে হ্যান্ডসাম ক্রিকেটার বলে। আমাদের সময়ে তার প্রচুর মেয়ে ফ্যান ছিল। কিন্তু রজার বিনির মতো সুপুরুষ ক্রিকেটার আমি খুব কম দেখেছি। উইকেট নেওয়ার পর তার সেলিব্রেশানও সুন্দর – মাথার ওপর একটা হাততালি দিয়ে হাসতে হাসতে উইকেট কিপারের দিকে ছুটে যেতেন বিনি। তবে তার লো প্রোফাইল মেন্টেন করার স্বভাব সম্ভবত তার ফ্যানবেস ততটা বাড়তে দেয় নি।

সেদিন দেখলাম ধারাভাষ্যকার রাহানের ড্রাইভকে ‘পোলাইট ড্রাইভ’ নামে ডাকছেন। অর্থাৎ কোনরকম হিংস্রতা নেই তার শটে, আলতো করে ব্যাট বুলিয়ে দিচ্ছেন বলের ওপর। তা, বিনির স্যুইংকেও ‘পোলাইট স্যুইং’ বা বিনয়ী স্যুইং বলা যেতে পারে।

মনে আছে একবার নয় সানি গাভাস্কার নয় রবি শাস্ত্রী দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে বিনিকে নিয়ে এসেছিলেন স্যুইং দেখাবেন বলে। আউট স্যুইং – ইন স্যুইং দুটোই বল করে দেখিয়েছিলেন বিনি সেদিন। চমৎকার লাইন এবং লেন্থও রেখেছিলেন। মনে হয় না খুব বেশি রিটেক করতে হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link