যেদিকে যাই, ট্রফি পাই

তিনি পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপের মত মাঠে আবেগ তাড়িত হয়ে যান না। তিনি হোসে মরিনহোর মত অদ্ভুতুড়ে কোন বক্তব্য দেন না। ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে ট্যাকটিক্স বাতলে দিতেও দেখা যায় না তাঁকে। তাঁর চোখের ভ্রুর ইশারাতেই শিষ্যরা বুঝে যায় কি করতে হবে।

তিনি পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপের মত মাঠে আবেগতাড়িত হয়ে যান না। তিনি হোসে মরিনহোর মত অদ্ভুতুড়ে কোন বক্তব্য দেন না। ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে ব্যস্তভাবে ট্যাকটিক্স বাতলে দিতেও দেখা যায় না তাঁকে। তাঁর চোখের ভ্রুর ইশারাতেই শিষ্যরা বুঝে যায় কি করতে হবে।

শান্ত আর বিনয়ী এই কোচের নাম ফুটবলের খোঁজ খবর রাখা সবাই নিশ্চয়ই জানে। বিশেষ করে ২০২১/২২ মৌসুমে চোখের ভ্রুর জাদু দেখানোর পর ইতালিয়ান কার্লো আনচেলত্তিকে না চেনার তো কিছু নেই। 

১৯৫৯ সালের জুনে ইতালির রেগিলো গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। আনচেলত্তির পরিবারের আয়ের উৎস ছিল পনির ফার্ম। তাই তাকেও এই ফার্মে কাজ করতে হয়েছিল। এখান থেকে শৃঙ্খলা আর কঠোর পরিশ্রমের বিদ্যা লাভ করেন তিনি। সেই সাথে বাবার হাড়ভাঙা খাটুনি দেখে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন যাতে নিজের বাবাকে এমন কষ্ট করতে না হয়। 

কার্লো আনচেলত্তির এই স্বপ্ন তাকে টেনে নিয়েছিল রেগিলো যুব একাডেমিতে। ফার্ম থেকে উঠে আসা কিশোর আনচেলত্তির উপর সে সময় চোখ পড়ে পার্মা ক্লাবের। এরপর পার্মাতে চলে আসেন আনচেলত্তি। প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা এই ইতালিয়ানের জন্য নতুন শহরে চলে আসা ছিল চ্যালেঞ্জের মত। তবে সেই চ্যালেঞ্জ থামাতে পারেনি তাকে। 

পার্মা থেকে একটা সময় পর রোমাতে যোগ দেন কার্লো আনচেলত্তি। সেখানে একটি লিগ শিরোপা এবং চারটি কোপা ইতালিয়া জিতে নেন তিনি। আট বছর সেখানে কাটানোর পর এসি মিলানের জার্সি গায়ে জড়ান কার্লো। অ্যারিগো সাচ্চির কোচিংয়ে সে সময় টানা দুইটি ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) জিতে নেয় মিলান।

১৭ বছর বয়সে নিতান্তই এক সাধারন বালক হিসেবে নিজের গ্রাম ছেড়েছিলেন, এরপর ৩৩ বছর বয়সে যখন ফুটবলকে বিদায় বলেছিলেন তখন তিনি একজন ইতালিয়ান আইকন।

বুটজোড়া তুলে রাখলেও ফুটবলের মায়া ছাড়তে পারেননি কার্লো আনচেলত্তি। ফিরে আসেন একজন কোচ হয়ে। ১৯৯২ সালের পর থেকে তিন বছর সাচ্চির অধীনে ইতালি জাতীয় দলের সহকারি কোচ ছিলেন তিনি। হেড কোচের চেয়েও নিজের শৃঙ্খলা আর ট্যাকটিক্সে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন কার্লো।

সিরি বি এর ক্লাব রেজিয়ানার দায়িত্ব নেয়ার মধ্য দিয়ে হেড কোচ হিসেবে অভিষেক হয় কার্লো আনচেলত্তির। প্রথম বছরেই দলটিকে সিরি এ-তে উন্নীত করেন তিনি। এরপরই কিশোরকালীন ক্লাব পার্মা তাকে প্রস্তাব দেয় কোচিংয়ের।

জিজি বুফন, ফ্যাবিও ক্যানাভেরোর মত কিংবদন্তিরা ছিলেন তৎকালীন পার্মা দলের সদস্য। কোন ট্রফি জিততে না পারলেও পার্মাতে থাকা আড়াই বছরে তিনি নিজের কোচিং বিদ্যার ঝলক দেখান।

বড় দলগুলোর মধ্যে প্রথম জুভেন্টাসের ডাগ আউটে দেখা যায় কার্লো আনচেলত্তি। কিন্তু প্রথম মৌসুমের শেষ ম্যাচের প্রথমার্ধে বিতর্কিতভাবে তাকে বরখাস্ত করে জুভেন্টাস। তখনো পর্যন্ত তুরিনের বুড়িদের লিগ জেতার সম্ভাবনা ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত জিততে পারে নি। 

এরপর এসি মিলানের হেড কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন কার্লো আনচেলত্তি। দলটির হয়ে নিজের আট বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে তিনবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে খেলেছেন তিনি। একবার জিততে না পারলেও দুইবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করে এসি মিলান। এছাড়া ক্লাবটির হয়ে একটি লিগ শিরোপা, একটি কোপা ইতালিয়া এবং একটি সুপার কোপা জিতেছিলেন।

রোমান আব্রামোভিচের প্রবল আগ্রহের কারনে এসি মিলানের সাথে সম্পর্কের ইতি টেনে চেলসিতে চলে আসেন কার্লো আনচেলত্তি। তাঁর অধীনে শুরুর মৌসুমে ১০৩টি গোল করে প্রিমিয়ার লিগ ঘরে তোলে ব্লুজরা। অবশ্য পরের মৌসুমে লিগে দ্বিতীয় হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করে টিম ম্যানেজম্যান্ট। তবে আনচেলত্তির সাফল্য থেমে যায়নি। প্যারিস সেন্ট জার্মেই এর হয়ে ফরাসি লিগ জেতার স্বাদ পান তিনি। 

২০১৩ সালে হোসে মরিনহোর বিদায়ের পর রিয়াল মাদ্রিদ খুঁজে নেয় কার্লো আনচেলত্তির ছায়া। এখানেও দাপটের সাথেই নিজের শুরুটা করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে বিখ্যাত লা ডেসিমা জয়ের পাশাপাশি কোপা দেল রে জিতেছিল রিয়াল। পরের বছর বিদায় নেয়ার পর বায়ার্ন মিউনিখ, নাপোলি, এভারটন ঘুরে ২০২১ সালে আবারো লস ব্ল্যাঙ্কোসদের ড্রেসিং রুমে ফিরে আসেন এই ট্যাকটিশিয়ান। 

২০২২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং লা লিগা ঘরে তোলে অল হোয়াইটরা। আর এরই মধ্য দিয়ে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের সব কয়টি জেতার রেকর্ড করেন কার্লো আনচেলত্তি। নতুন মৌসুমকে সামনে রেখে নতুনভাবে আবারো দলকে গড়ে তুলছেন তিনি। 

কখনো কখনো বলা হয়, সাবেক কোচদের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলেন কার্লো আনচেলত্তি। কিন্তু এটা একদমই সত্য নয়। পুরোনো সাফল্য কখনোই নতুন করে কিছু দেয় না, অর্জন করে নিতে হয়। আর আনচেলত্তি নিজের ক্যারিয়ারে যেখানেই কোচিং করিয়েছেন সেখানে নিজের যোগ্যতায় সেরাদের একজন হয়েছেন। 

খেলোয়াড়ী জীবন থেকেই লাইমলাইট এড়িয়ে চলেন কার্লো আনচেলত্তি। এই ভদ্রলোককে কখনো কোন বিতর্ক ছুঁয়ে দেখতে পারেনি। ফুটবলকে নিয়ে সাধনা করেছেন, করছেন। ফুটবলার এবং কোচ হিসেবে গত ৪৬ বছরে যত অর্জন রয়েছে তাঁর, সেটাই প্রমাণ করে আনচেলত্তি কতটা সেরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ঘরোয়া লিগ শিরোপা, লিগ কাপ সহ সম্ভাব্য সব ট্রফি খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে জিতেছেন তিনি। 

এতকিছুর পরেও ফুটবলের সেরা কোচদের তালিকায় প্রায় উপেক্ষিত হন কার্লো আনচেলত্তি। এর একটা কারন হতে পারে, তাঁর দীর্ঘস্থায়ীত্ব নেই। একমাত্র এসি মিলান ছাড়া আর কোন ক্লাবে তিনি লম্বা সময় কোচ ছিলেন না। তার পরও ইতালির হল অব ফেমে জায়গা পাওয়া এই কিংবদন্তি কোচকে সেরাদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়াটা পরিহাস ছাড়া কিছুই নয়। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...