রিভার্স স্যুইং শিল্প ও সরফরাজ নওয়াজ

ক্রিকেট মাঠের খুব পরিচিত দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হল বলে লালা লাগিয়ে বলটকে পালিশ করা। মাঝে মাঝে বোলাররা তাদের ট্রাউজারে ঘা দিয়েও এই কাজ করার চেষ্টা করেন। এখন প্রশ্ন হল কেন তারা এই কাজ করেন?

উদ্দেশ্য একটায় বলের এক পাশ অপেক্ষাকৃত ভারি রাখা। অনেক ওভার ধরে এটা করতে থাকলে বলটার এক পাশ রুক্ষ বা খসখসে হয়ে যায়, অন্য পাশটা থাকে মসৃণ। এটা শুধু খেলার স্বাভাবিক সুইংয়ে সাহায্য করে শুধু তাই নয় খেলার শেষ ওভারগুলোতে বলটা রিভার্স স্যুইংয়ে ( উল্টো দিকে) বেশ কাজে দেয়। পেস বোলিংয়ের সবচেয়ে কঠিন এই শিল্পকে ডার্ক আর্ট বা গোপন বিদ্যাও বলে।

৭০-৮০ এর দশকে এক পাকিস্তানি পেস বোলারের হাত ধরে আসে এই অস্ত্র। ইমরান খানের সাথে জুটি বেধে বল করা সেই সরফরাজ নেওয়াজ নেটে অনুশীলন করতে করতে আবিস্কার করেন এই বোলিং কৌশল। পেস বোলিংয়ে এটা নি:সন্দেহে ইতিহাস কাঁপানো আবিস্কারগুলোর একটি ছিল।

পাকিস্তানের প্রথম সুইং সুলতান বলেন আর রিভার্স স্যুইংয়ের আবিস্কারক বলেন – সবই তিনি । পরবর্তীতে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুসরা এই রিভার্স স্যুইং ধরে কাপিয়ে দিয়েছিলেন পুরো বিশ্ব কিন্তু এর শুরুটা করে দিয়েছিলেম সরফরাজ নওয়াজ। ওয়াসিম, ওয়াকারদেরও রিভার্স স্যুইংয়ের প্রথম দীক্ষা দিয়েছিলেন সরফরাজ নওয়াজ।

ব্যবসায়িক পরিবারে বেড়ে উঠা সরফরাজ পারিবারিক ব্যবসা দিয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেন। তাদের একটা ‘কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’ ছিল। ১৯৬৫ সালে সেখানে যোগ দিয়েই তাঁর আস্যাইনমেন্ট ছিল লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মান করা।

১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর এই কাজ বন্ধ হয়ে যায় ফলশ্রুতিতে তাঁদের কোম্পানি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কিন্তু এতে করে লাভভান হয় হয় পাকিস্তান ক্রিকেট সরফরাজের নওয়াজের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে আসে ক্রিকেট।

ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি নির্মাণের কাজ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কিছু ছেলে সেখানে ক্রিকেট খেলতে শুরু করে। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সরফরাজ ছেলেদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে তাদের খেলা চালিয়ে যেতে বারণ করেন এর পরিবর্তে, তারা তাকে খেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।

তদের মধ্যে ছিল আফতাব গুল, ওয়াসিম রাজা, সলিম আলতাফ, শফিক আহমেদের মত ক্রিকেটার। ধীরে ধীরে এই খেলাটির প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয় যোগ দেন স্থানীয় একটি ক্রিকেট ক্লাবে৷ লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে খেলার সময় পাকিস্তান জাতীয় দলের কিছু ক্রিকেটারের সান্নিধ্যে নিজেকে আরো বিকশিত করেন সরফরাজ।

এরপর মাত্র দুই বছরের মাথায় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক। মাত্র পাঁচটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলার পর জাতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সিরিজে ডান পান। ১৯৬৯ সালে করাচিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক।

এরপর ১৯৭৩ সালে নিজের তৃতীয় টেস্টেই সিডিনিতে অজিদের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৪ টি করে ৮ টি উইকেট নেন। এরপরে নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও প্রথম ইনিংসে নেন চার উইকেট। ক্যারিয়ারের শুরুতেই আলো ছড়িয়ে দলের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেন সরফরাজ। এরপর একটা সময় রিভার্স স্যুইং আয়ত্ত করার ২২ গজে রীতিমতো ব্যাটসম্যানদের আতংকে পরিণত হোন। ৫৫ টেস্টে ১৭৭ উইকেটের পাশাপাশি হাজারের বেশি রান করেছেন।

১৯৭৩ সালে ওয়ানডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। কিউইদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ৪৬ রান দিয়ে নিয়েছিলেন চার উইকেট। সবমিলিয়ে ৪৫ টি ওয়ানডেতে খেলেছেন ৬৩ উইকেট। এই পরিসংখ্যানগুলো দিয়ে তাকে মাপা উচিত হবে না কেননা পাকিস্তান ক্রিকেটে তাঁর অবদান এই সংখ্যাগুলো দেখে বোঝা যাবে না।

দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন মূকত রিভার্স স্যুইংয়ের জন্ম দিয়েছেন বলে। পরবর্তীতে যেই অস্ত্র কাজে লাগিয়ে ক্রিকেট মাঠে পরবর্তী তিন দশক ছড়ি ঘুরিয়েছে পাকিস্তানি পেসাররা। এরপর আরো অনেকেই এই কৌশল রপ্ত করার চেষ্টা করেছে তবে সেখানে সফলতার হার অনেক কম। আর এর কৃতীত্বটা তাঁর জনককে দিতেই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link