লড়ো রক্তের শেষ বিন্দু অবধি

২০০০ সালে সৌরভ জমানা শুরুর মুখে টেস্টে ক্যাপ এল কিছুটা আকস্মিকভাবেই। সৌরভ অধিনায়ক হবার পর দলে পাকাপাকিভাবে নিয়ে এলেন ছেলেটাকে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত এক সংবাদ সংস্থা ওয়ানডে দলে কাইফের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে টিপ্পনি কেটে লিখল- ‘ওয়ান লাগেজ হুইচ ফিল্ডস ওয়েল।’ সৌরভ তার পাল্টা দিয়ে বললেন- 'দ্য গোল্ড ইনসাইড লাগেজ হি ইজ ’।

ভারতের হয়ে ১২৫ ম্যাচে ২৭১৫ রান।

১১ নম্বর জার্সির হাসিখুশি ছেলেটাকে ভুলে যাবার জন্য এটুকুই যথেষ্ট, পুরোনো ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে বা হালফিলের আইপিএল-ক্রিকেট দুনিয়ায় হাজারে হাজারে রেকর্ড, জাতীয় দলের প্রায় বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের ব্যাটিং গড়, লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে মহেন্দ্র সিং ধোনির সুনামি আছড়ে পড়া- সবকিছুর পর ১১ নম্বর ক্রমে মিলিয়ে গেছে মহাকালে।

এখান থেকেই প্রথম রানটার জন্যে দৌড় শুরু করেন মোহাম্মদ কাইফ। দুটো হাত উঁচিয়ে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে থাকেন অপোসিট এন্ডের উইকেটটার দিকে। তিনি জানেন, তিনি বুঝতে পারেন – এই শেষ সুযোগ, চোখের সামনে তাঁর গুরু, তাঁর বড় দাদা সৌরভ যে চারাগাছটা বুনেছেন আজ তার মহীরুহ হয়ে ওঠার দিন।

আজ বন্দীপ্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে মাথা চারা দিয়ে সবুজ পাতাগুলোকে মেলে দিতে হবে খোলা আকাশে| চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে অজয় জাদেজা, বিক্রম রাঠোর, মাঞ্জরেকার অধ্যায়ের পর ভারতীয় ক্রিকেটের রেনেসাঁসের উত্তপ্ত আঁচের কুরুক্ষেত্রে এসে পড়া তার।

উত্তরপ্রদেশের হয়ে রঞ্জি খেলার সময় জাতীয় দলের সিলেকশনে বলা হয়েছিল এত অর্ডিনারি ব্যাটিং-এ জাতীয় দলের দরজা কোনোদিন খোলা সম্ভব না। ২০০০ সালে সৌরভ জমানা শুরুর মুখে টেস্টে ক্যাপ এল কিছুটা আকস্মিকভাবেই।

সৌরভ অধিনায়ক হবার পর দলে পাকাপাকিভাবে নিয়ে এলেন ছেলেটাকে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত এক সংবাদ সংস্থা ওয়ানডে দলে কাইফের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে টিপ্পনি কেটে লিখল- ‘ওয়ান লাগেজ হুইচ ফিল্ডস ওয়েল।’ সৌরভ তার পাল্টা দিয়ে বললেন- ‘দ্য গোল্ড ইনসাইড লাগেজ হি ইজ ’।

সৌরভ আর দ্রাবিড় জানতেন ছেলেটা মাঠে নামে মোহাম্মদ কাইফ হয়ে নয়, নামে ভারতের সিপাহি হয়ে।প্রথম মাঠে নামার দিন থেকে নিজের দলে জায়গা পাকা করার জন্যে নয়, দলের প্রয়োজনে সৌরভ যা দায়িত্ব দিয়েছেন একজন যোগ্য সেপাই হয়ে তা করে গেছেন কাইফ।

নিজের চেয়ে দলের স্বার্থে দুহাতে চেপে ধরেছেন লং অনে উড়ে আসা ক্যাচ। প্রতিম্যাচে ব্যাটিং-এ সুযোগ না পেলেও হাসিমুখে দলের হয়ে সারামাঠ চষে দিয়েছেন ‘ফ্লাইং কাইফ’।

ক্রিজে ব্যাটটা রাখতেই ওভার থ্রোটা দেখে ফের দৌড়, ফিনিশিং লাইনের আগে শেষ ল্যাপে নিজের জীবনের সমস্ত রেকর্ড বাজি রেখে নিজের শরীরটা ছুঁড়ে দিলেন কাইফ। ছুঁড়ে দিলেন নিজের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি স্যাক্রিফাইস করে। নিজের ব্যক্তিগত অপরাজিত থাকার রেকর্ডের পরোয়া না করে লর্ডসের ঐতিহাসিক ব্যালকনিতে একখণ্ড ভারতকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেখার আনন্দটা।

উঠে দাঁড়াতেই ইতিহাস হয়ে গেল সবকিছু। অনেকদিনের জমাট ব্যথার বুকে কাইফের ছুঁড়ে দেওয়া ব্যাট বিদ্যুতের ঝলক হয়ে বৃষ্টি নামাল ব্রিটিশ মুলুকে। সেদিন ছিল আবেগের বিপ্লব, কাইফের শরীরটা জাপটে সবুজ গালিচায় শুয়ে পড়লেন দাদা। সমস্ত ভারতবর্ষ যেন তাঁর নিথর হতে থাকা বুকে জাপটে ধরল সন্তানদের।

সৌরভের ভরসার কুঁড়ি গোলাপ হয়ে ফুটল ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটাতেই। সৌরভ আর বীরুর দাঁতেদাঁত চাপা লড়াইটা যখন পরপর উইকেট খুইয়ে ভেঙে যাবার মুখে তখন যুবি আর কাইফের হাতে প্রাণ এল ফের।

যুবির চলে যাবার পর জাহিরকে নিয়ে কাইফ প্রমাণ করে দিলেন ক্রিকেটের রেকর্ডবুকের অনেক অনেক বাইরে থেকে তিনি কোনো অচেনা মহাদেশে ভারতের পতাকা নিয়ে মাঠে নামেন। তিনি মাঠে নামেন মাত্র ২৭১৫ রান আর তার সারাদেহে মুড়ে রাখা ভারতের মাটির ঘ্রাণ নিয়ে।

সেই ১৩ জুলাই, ২০০২।  কাইফের আস্থার পায়ে দাঁড়িয়েছিল ভারত। বিলেতের মাটি পেয়েছিল ভারতের লড়াইয়ের শেষ রক্তবিন্দু। তাঁর জীবনস্তন্যে ধন্য হয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। কিংবদনন্তি ক্রিকেটাররা নয় সেদিন এই সিপাহির সাহসের সুধায় ধন্য হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...