ইতালির নাপোলি শহর এখনও ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে তাদের শহরের ‘দেবতা’ মনে করে। একটি মধ্যম মানের দল নাপোলিকে ফুটবল মানচিত্রে তুলে ধরার জন্য ঝাঁকড়া চুলের ফুটবল ঈশ্বরের ‘১০ নম্বর’ জার্সি এখনও ম্যারাডোনার জন্যই সংরক্ষিত। ফুটবল প্রাঙ্গন থেকে চোখ সরিয়ে ক্রিকেট দুনিয়াতেও রয়েছে এমন স্টারডম।
প্রায় দশ বছর হতে চলল, শচীন টেন্ডুলকার বাইশ গজকে বিদায় বলেছেন। কিন্তু এখনও দলের মেন্টর ভূমিকায় থাকা শচীনকে যখন জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যায়, তখনই সমস্বরে ভেসে ওঠে ‘শচীন শচীন’ জয়োধ্বনি। মহেন্দ্র সিং ধোনিকে নিয়ে ভারতীয়দের ক্রেজ আবার অন্য রকম।
প্রতিপক্ষের মাঠে এক ধোনির উপস্থিতিতেই প্রতিপক্ষরাই নিজেদের মাটিতে পরবাসী হয়ে যান। কারণটা ধোনি। ঐ এক মাহি মোহেই দর্শকদের সব আগ্রহ থাকে ৭ নম্বর জার্সিধারী ভারতের হয়ে সর্বজয়ী অধিনায়ককে নিয়ে।
ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে তাদের দেশের মানুষের এমন উচ্ছ্বাস নতুন কিছু নয়। শচীন, ধোনির পর দর্শক, সমর্থকদের মাঝে উচ্ছ্বাসের আরেকটা উৎস বিরাট কোহলি। মাঠে আগ্রাসী ভূমিকায় থাকা কোহলিকে অনেকেই পছন্দ করেন না।
কিন্তু, এই বিরাটকে নিয়েও ভারতীয়দের রয়েছে পরম আবেগ আর উচ্ছ্বসিত অনুভূতি। মজার ব্যাপার হলো, দিল্লিতে বেড়ে ওঠা এই বিরাট এখন ব্যাঙ্গালুরুর মধ্যমণি।
আইপিএলের শুরু থেকেই এই দলের হয়ে খেলছেন কোহলি। দীর্ঘ এ যাত্রায় রেকর্ডও গড়েছেন। আইপিএলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় শীর্ষে থাকা নামটা কোহলি। কিন্তু ব্যক্তিগত অর্জনে যেখানে তিনি শীর্ষে, দলগত সাফল্যে ঠিকই তলানিতে। একটি বারের জন্যও আইপিএল শিরোপা জেতা হয়নি কোহলির।
কিন্তু। তাতে কী! রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে কোহলি মাঠে নামলে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ১৮ নম্বর জার্সিতে ছেয়ে যায় গোটা স্টেডিয়াম। এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে কোহলির উপস্থিতি মানেই গ্যালারিতে উৎসবের এক মঞ্চ।
বোঝার উপায় নেই, কোহলি দিল্লীর ঘরের ছেলে নাকি ব্যাঙ্গালুরুর! দিল্লীতে বেড়ে ওঠা হলেও কোহলি নিজেও হয়তো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের পরে ব্যাঙ্গালুরুকেই আপন ঠিকানা ভাবেন।
ব্যাঙ্গালুরুতে এ ক্রিকেটার এতটাই মোহাবিষ্ট যে, একবার বলেছিলেন,’আমি ব্যাঙ্গালুরুর হয়েই ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে চাই।’ কোহলির এমন আবেগকেও যথার্থ মূল্যায়ন করেছে ব্যাঙ্গালুরু। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর আইপিএল যাত্রার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ধ্রুব এক নাম ‘কোহলি’।
সেই ১৯ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন। এরপর টানা ১৬ বছর। এর মাঝে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লম্বা এক দু:সহ সময় পেড়িয়েছেন। কোহলির সেই দু:সময়ে বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন অনেকেই। কোহলি ফুরিয়ে গেছেন, এমন তীক্ষ্ণ কথার তিরে তাঁকে বিদ্ধ করেছেন অনেক ক্রিকেট অনুরাগীরাই। কিন্তু ব্যাঙ্গালুরুর মানুষ বরাবরই কোহলির পাশে ছিল নি:স্বার্থভাবে।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুকে কিছুই জেতাতে পারেননি। কিন্তু তারপরও ব্যাঙ্গালুরুর ঐ জার্সি গায়ে কোহলির উপস্থিতি মানেই যেন ব্যাঙ্গালুরুর সমর্থকদের উচ্ছ্বাসের দারুণ এক উৎস।
এবারের আইপিএলে ব্যাঙ্গালুরু যে অতি আহামরি পারফর্ম করছে সেটাও নয়। কলকাতার কাছে দুই ম্যাচেই স্পিন বিষে নীল হয়ে জুটেছে পরাজয়। যার একটি আবার নিজেদের মাটিতে।
ব্যাঙ্গালুরুর সমর্থকরা মাঠে এসেছেন। দলের সেই পরাজয় দেখেছেন। হতাশ হয়েছেন। কিন্তু বিরাট কোহলি যেন শত হতাশার মাঝেও তাদের জন্য স্বস্তি আর পরম আবেগের নাম।
কোহলি সাবলীল ব্যাটিং করছেন, তাতে অনুমিতভাবেই গ্যালারি জুড়ে উচ্ছ্বাস। আবার যখন আউট হয়ে হতাশায় মাথা নত করে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটছেন, তখনও গ্যালারি থেকে ‘কোহলি, কোহলি’ বন্দনা।
সমর্থকদের কাছ থেকে উচ্ছ্বাসের এমন উত্তাপ নিশ্চয়ই টের পান কোহলি। আর সে কারণেই প্রতি আইপিএলে শিরোপার দিকে চোখ রেখেই মিশন শুরু করেন তিনি। যদিও বারবারই হতাশায় শেষ হয়েছে সে মিশন। কোনো শিরোপা ছাড়াই ব্যাঙ্গালুরুতে কোহলির যেমন ক্রেজ, একবার আইপিএল শিরোপা জেতাতে পারলে অবস্থাটা কেমন হবে বলুন?
ম্যারাডোনা হয়েছিলেন নাপোলির দেবতা। সমগ্র ভারতীয়দের কাছে ঈশ্বর বনে গিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার। সময়ের স্রোতে, কোহলিও কি সেই পথে আছেন? হ্যাঁ। নিশ্চিতভাবেই আছেন। ব্যাঙ্গালুরুর মসনদের এখনই যে তিনি মুকুটহীন রাজা।