কত সহস্র রাত সূর্যের তাপে হারিয়ে গেলে এমন এক রাতের জন্ম হয়। হঠাৎ এক ধুমকেতু হয়ে আবির্ভাব ঘটে জুলস কুন্দের। ডি-বক্সের বাইরে থেকে এক জোরাল শট খুঁজে নেয় তিন কাঠির নিচের ওই জালের ঠিকানা। গ্যালারিতে লাল রঙা ফ্লেয়ারের সাথে মিশে যেতে চান রোনাল্ড আরাউহো। এমন অবিস্মরণীয় রাত জীবনে আর ক’বারই বা আসে!
কোপা দেল রে ফাইনাল। স্প্যানিশ দুই চিরপ্রতিদ্বন্দীর মাঠের লড়াইয়ের আগেই উত্তাপ্ত স্পেনের ফুটবল পাড়ায়। রিয়াল মাদ্রিদের খেলতে না চাওয়ার হুঙ্কার ছাপিয়ে ম্যাচটা মাঠে গড়াল। মাদ্রিদের সোজাসাপ্টা পরিকল্পনা, প্রথম অর্ধে গোল হজম করা যাবে না। ডিফেন্স লাইনে চার জন। মধ্যমাঠে রদ্রিগো নিচে নেমে পাঁচ। একেবারে আঁটসাঁট অঞ্চল।
একে তো বার্সেলোনার হাই লাইন ডিফেন্সের কারণে এমনিতেই জায়গা কম, এরপর আবার মধ্যমাঠ ভারী করে বার্সার ফ্রি ফ্লোয়িং গেমপ্লে-তে কোচ কার্লো আনচেলত্তির বাঁধা। কিন্তু এসব নিয়ে পেদ্রি কেনই বা ভাবতে যাবে বলুন! মাদ্রিদের আক্রমণ প্রতিহত করে পালটা আক্রমণে পেদ্রির এক সুবিশাল লং বল। অসাধারণ দক্ষতায় নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে লামিন চলে গেলেন মাদ্রিদের ডি বক্সের দিকে।
মাদ্রিদের ওই আঁটসাঁট রক্ষণ আর মধ্যমাঠ তখন ভেঙেচুড়ে চুরমার। সবার ধ্যান তখন ১৭ বছর বয়সী লামিনের দিকে। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় তিনি দেখে ফেললেন দৌড়াতে থাকা পেদ্রিকে। বাড়িয়ে দিলেন বল- পেদ্রির শটে গোল। বার্সেলোনা মাদ্রিদের কৌশল বোর্ড ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিল। ওই একটা গোলই বলে দেয়, পেদ্রিদের মধ্যমাঠে সৃজনশীলতা আর দূরদর্শিতা ঠিক কতটা তীক্ষ্ম।
তবুও মাদ্রিদ তো ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। আগের দুই এল ক্ল্যাসিকোর বদলা তো নেওয়া চাই। প্রচণ্ড দাপটে বার্সাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলে মাদ্রিদ। কাতালান ডি-বক্সের ঠিক সামনে ফ্রি-কিক। তখনও ১-০ গোলে পিছিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ। আর্দা গুলার আর কিলিয়ান এমবাপ্পে দাঁড়িয়ে বলের সামনে। বার্সার ধারণা ছিল আর্দাই হয়ত শট চালাবেন। মানবদেয়াল অন্তত সেই অনুযায়ী তৈরি ছিল।
কিন্তু এমবাপ্পে কিকটা নিলেন ঠিক যেদিকে সেজনি ছিলেন দাঁড়িয়ে। আটকাতে পারলেন না। ম্যাচে ফিরল মাদ্রিদ। যেন সহস্র বছর ধরে মরুভূমি হওয়া ফুসফুসে এক পসলা বৃষ্টি। এরপর সেই আর্দার ক্রস থেকে অরেলিয়েন শুয়ামিনির গোল। ২-১ গোলে এগিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ। লস ব্ল্যাঙ্কোসদের উচ্ছ্বাস তখন সাত আসমানের চাইতেও খানিকটা উপরে। গ্যালারিতে স্লোগান, আসি গানা এল মাদ্রিদ। অর্থাৎ মাদ্রিদ এভাবেই জেতে।
কিন্তু বার্সেলোনা তখন নিজেদের রুপকথা লিখতে শুরু করেনি। ফেরেন তোরেস সেই রুপকথার প্রথম অধ্যায়টা লিখলেন। থিবো কর্তোয়ার মত প্রায় নির্ভুল এক গোলরক্ষকের গোল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার ফায়দা তুলে স্কোরশিটে নাম তোলেন তোরেস। ম্যাচের তখন ৮৪ মিনিট। স্নায়ুচাপে অক্সিজেন যেন অ্যাডামস অ্যাপেলের ওইদিকটায় আটকে যাওয়ার উপক্রম।
ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। ওই সবুজ গালিচা যেন পরিণত হয় সাদাকালো দাবার কোর্টে। খানিকটা নিরবতা, হুট করেই ভেল্কি দেখানো সব চালে দর্শকরা দিশেহারা। সবাই ধরেই নিয়েছে ম্যাচ চলে যাচ্ছে টাইব্রেকারে। রিয়াল আবার টাই ব্রেকারে স্নায়ুরচাপটা সামলে নিতে পারে ভাল। কিন্তু শেষ অধ্যায়ের রুপকার জুলস কুন্দের আগমন ঘটে একেবারে অন্তিম লগ্নে।
ম্যাচের ১১৬ তম মিনিট। লুকা মদ্রিচ পাস বাড়িয়েছেন ব্রাহিম দিয়াজের দিকে। ঠিক কতটা চাপে থাকলে ডি-বক্সের সামনেও ভুল করা যায়! দিয়াজ ভুল করলেন। প্রেসের জন্যে এগিয়ে যেতে থাকা কুন্দে বল পেয়ে গেলেন। দ্বিতীয় টোকায় বলটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে সপাটে লাথি। থিবো কর্তোয়া নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েও পরাজিত সেনানী হয়ে রইলেন।
রোমাঞ্চ, উৎকণ্ঠা, বাক-বিতণ্ডা, গোল, পালটা গোল, গগনবিদারী চিৎকার চিন্তায় মুষড়ে যাওয়া, শেষমেশ শিরোপার উৎসবে মাতোয়ারা। ঠিক এ কারণেই তো ফুটবলের অমোঘ প্রেমে বুদ হয়ে থাকা। ঠিক এ কারণেই তো ফুটবলকে অগাধ ভালবেসে যাওয়া।