আমরা জানি, ক্রিকেটে খেলা হয় ওভারভিত্তিক, এবং প্রতি ওভারে ছয়টি বল করা হয়। কিন্তু ক্রিকেট ইতিহাসে এই হিসাবটা সবসময় একই ছিল না।
১৮৮৯ সালের আগে যতগুলো ম্যাচের রেকর্ড রাখা হয়েছে, সব ম্যাচেই ওভার হয়েছে চার বলে। এর মধ্যে প্রথম আর্ন্তজাতিক টেস্টের হিসেবও রয়েছে। পরবর্তীতে এক বল বাড়িয়ে পাঁচ বলে ওভার হিসেবে পরিবর্তিত হয়। ১৯০০ সালের দিকে ছয় বলে ওভার করার একটি চিন্তা করা হচ্ছিল, প্রথম শ্রেণীর কয়েকটি ম্যাচে ছয় বলে ওভার করানোতে তার প্রমাণ মেলে।
কিন্তু, তখনো আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ছয় বলে ওভার কেউ করেনি। কিছুদিন পরেই আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হলেও তারা দীর্ঘদিন এ বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারেনি, কারণ একেক অঞ্চলে একেক সিস্টেম চালু ছিল, হোস্ট দেশের নিয়ম অনুসারে খেলা হতো এবং সে অভ্যাস থেকে সরে আসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ছিল।
১৯২২-২৩ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া আট বলে ওভার হিসেবে খেলা শুরু করে। এবং দুই মৌসুম পরে নিউজিল্যান্ডও একই পন্থা গ্রহণ করে। তবে বিশ্বযুদ্ধের পর তারা আবার ছয় বলেই ওভার গণ্য করা শুরু করে।
অস্ট্রেলিয়া ৮০-এর দশকে ছয় বলে ওভার গণনার নিয়মে পুরোপুরিভাবে ফিরে আসে।
১৯৩৯ সালে, ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটেও পরীক্ষামূলকভাবে আটটি বলের ওভার শুরু করে। তবে এই পরীক্ষা বেশিদিন চলতে পারেনি, মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়।
কারণ চারদিকে তখন বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। যুদ্ধ শেষে যখন ক্রিকেট আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসে, তখন ইংলিশরা আটবলের ওভারপ্রণালীর দিকে আর যায়নি, ফিরে আসে ছয় বলের নিয়মেই।
টেস্ট ক্রিকেটের আরেক প্রবীণ সদস্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৩৮-৩৯ এবং ১৯৫৭-৫৮ এই দুই সেশনে আটবলে ওভার গণ্য করা হত। মাঝখানে ২০টি বছর বর্ণবাদ সমস্যায় ক্রিকেট থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ছিল।
ভারত ১৯১৪-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ছয় বলে ওভার হিসেবেই খেলতে থাকে। কিছু কিছু প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৫বলে ওভার খেলারও নথি পাওয়া যায়। ১৯৩৯থেকে বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়টুকুতে তারা আটবলে এক ওভার হিসেবে খেলতে থাকে। পরবর্তীতে তারা আবারো ছয়বলে এক ওভার নিয়মেই ফিরে আসে।
পাকিস্তানি ক্রিকেটে আশির দশকে আটবলে এক ওভার করে খেলার প্রচলন ঘটে। ১৯৭৪-৭৫ এবং ১৯৭৬-৭৭মৌসুমে বেশকটি ম্যাচে তারা আটবলের ওভার গণনা করে। তবে ১৯৭৯ এর পর কোন দেশের কোন ম্যাচেই আর আটবলে ওভার গণনা করতে দেখা যায়নি।
কিন্তু এভাবে বারবার নিয়ম বদলে ফেলার কারণ কিংবা ছয় বলের ওভারকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ কোনো পুরোনো নথিতে পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রথমদিকে বল যেন দ্রুত নষ্ট না হয়, তাই ৪বলে ওভার করা হত, যেন এক বল দিয়ে সারাদিন খেলা যায়।
তবে তখনকার ক্রিকেটমেন্টররা ৫বলের ওভারকে স্ট্যান্ডার্ড মনে করতেন। তাই বলের গুণগত মান বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়, এবং ৫বলের ওভার করতে চেষ্টা করা হয়, এবং ধীরেধীরে তা জনপ্রিয়তাও পায়।
তবে অস্ট্রেলিয়ানদের আটবলে ওভার প্রচলনের পেছনে কোন অফিসিয়াল লজিক খুঁজে পাওয়া যায়নি, কিংবা সুনির্দিষ্ট কোন যুক্তিও দেখানো হয়নি। একেক বিশ্লেষক একেকভাবে সিদ্ধান্তটিকে ব্যাখ্যা করেছেন।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে স্বর্ণযুগ চলছিল বলা যায়। সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা বোলার, সর্বকালের অন্যতম সেরা দল, অস্ট্রেলিয়ান দলের চাহিদা ছিল ব্যাপক।
অস্ট্রেলিয়ার খেলায় দর্শকসমাগম বেশি হত। তাই ওভারে বলের পরিমাণ দু’টি বাড়িয়ে দেয়া হয়, অপরিণামদর্শী কর্তাব্যক্তিরা ভেবেছেন এটা কোন বিশাল পার্থক্য হবেনা খেলোয়াড়দের জন্য, বরং দিনে খেলার পরিমাণ বাড়বে, টিকেটের দাম এবং দর্শক যুগপৎ বেড়ে যাবে। কিন্তু এর কিছু সাইডএফেক্ট দ্রুতই দেখা দিল।
ক্রিকেটাররা তাড়াতাড়িই হাপিয়ে উঠতেন, ব্যাটসম্যানরা এত বড় ওভার খেলতে খেলতে কখনো মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারতেন না, দিনশেষে বোলারদের গতি কমতে থাকত। ফাস্ট বোলাররা সিরিজ শেষেই ইনজুরিতে পড়তেন, পিচে দ্রুত ফাটল ধরত, ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা। বিভিন্নদেশ প্রথমে ব্যাপারটিকে স্বাগত জানালেও তারাও কিছুদিন পর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়। তাই আটবলের ওভার কনসেপ্টের ধীরেধীরে বিলুপ্তি ঘটে।
তবে পাঁচ বল থেকে ছয় বলে ওভারে সরে আসার অফিসিয়াল কোন কারণ জানা যায়নি, আবার ১৯৭৯এর পর সবার একযোগে এই নিয়মে সেটেলড হবারও কোন অফিসিয়াল কারণ রেকর্ড করা হয়নি।
কিন্তু এটি মানা হয় যে, ক্রিকেটের যথেচ্ছ বাণিজ্যিকীকরণ এবং ক্যারি প্যাকারের বিপ্লব এই ঐক্যকে অবধারিত করে ফেলেছিল।
তবে বিশ্লেষকদের মতেও ছয় বলে ওভার ক্রিকেটের জন্য আদর্শ। কারণ ছয় বলে একজন বোলার নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিতে পারেন, আবার অধিনায়ক খুব সুন্দরভাবে প্ল্যান সাজাতে পারেন, ব্যাটসম্যানরাও ক্লান্তবোধ করেন না।
ছয় বলের ওভারই সেরা ব্যালেন্স। ছয় বলের কারিকুরি কিংবা মিরাকল দেখাটা আসলেই দুর্দান্ত ব্যাপার!