দুলীপসিংজি, এক যুবরাজের আক্ষেপ

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ দুই ইনিংসে তাঁর রান সংখ্যা ১০৯ ও ৬৩। এরপরই আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি তাঁর। ডাক্তাররা একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছিলেন ওই বাইশ গজে নামতে। ফলে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই থেকে যায় তাঁর কালোর্ত্তীর্ণ হবার যাত্রা। হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ পরিসংখ্যান থাকতে পারতো এই ব্যাটসম্যানের।

তিনি ভারতীয়, তবে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ভারতে জন্ম নেয়া এই ব্যাটসম্যান হতে পারতেন ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় তারকা। তবে সব ধুলোয় মিশিয়ে তিনি রেখে গিয়েছেন এক ফালি আক্ষেপ। ২২ গজের এই যুবরাজ ক্রিকেট মাঠে এঁকে গিয়েছিলেন তাঁর সংক্ষিপ্ত মাস্টারপিস। যার চর্চা হবে আন্তত কাল ধরে। ভারতে জন্ম নেয়া সেই যুবরাজের নাম দুলীপসিংজি, কুমার শ্রী দুলীপসিংজি।

রঞ্জিতসিংজি ভারতের ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকা। তিনিই ভারতে জন্ম নেয়া প্রথম ক্রিকেটার যিনি ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন। ১৮৯৬ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষিক্ত হয়েছিলেন নওয়ানগরের এই রাজা। সেই রঞ্জিত সিংজিই গড়ে তুলেছেন ভাইপো দুলীপসিংজিকে।

নওয়ানগরের যুবরাজ দুলীপকে ছোট থেকে ক্রিকেটের দীক্ষা দিতে শুরু করেন রঞ্জিত। ফলে রঞ্জিত দুলীপের জন্য ছিলেন একজন কোচ, পরামর্শ ও সর্বোপরি একজন আদর্শ। অবশ্য এখনো ভারতে জন্ম নেয়া প্রতিটি ক্রিকেটারের আদর্শ এই দুইজন।

স্কুলে পড়া অবস্থাতেই ব্যাটিং দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন দুলীপ। ১৯২৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের হয়ে অভিষিক্ত হন তিনি। পরবর্তীকালে দলটির অধিনায়কও হয়েছিলেন দুলীপ। দুলীপের চাচা তিন যুগ আগে ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে গিয়ে বেশ ভুগেছিলেন। কেননা রঞ্জিতের সামনে কোনো উদাহরণ ছিল না। তবে দুলীপ ছোটবেলা থেকেই চাচার কাছে কাউন্টি ক্রিকেটের নানা গল্প শুনে বড় হয়েছেন। কী করে সাফল্য পেতে হয় তাঁর দীক্ষা নিয়েছেন। ফলে দুলীপ আর কোনো ভুল করেননি।

কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের হয়ে শত শত রান করতে থাকেন এই ব্যাটসম্যান। সব মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর ঝুলিতে আছে ১৫ হাজারের বেশি রান। ২০৫ টেস্টে প্রায় ৫০ গড়ে এই রান করেন তিনি। ওদিকে  স্কুল ক্রিকেটে বোলার হিসেবেও মন্দ ছিলেন না তিনি। তবে পেশাদার ক্রিকেটে লেগ স্পিনটা খুব একটা করতে দেখা যায়নি তাঁকে। তবুও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৮ উইকেটের মালিক তিনি।

অবশেষে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্টে অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেক টেস্টে খুব একটা সাফল্য পাননি তিনি। তবে পরের বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তুলে নেন তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি। এরপর ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লর্ডসে আবার সেঞ্চুরি করেন তিনি। সেটিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। ৩২১ বলে খেলেছিলেন ১৭৩ রানের ঐতিহাসিক সেই ইনিংস। ১৯৩১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবার সেঞ্চুরি করেন এই ক্রিকেটার।

তখন দিন দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে সেরাদের কাতারে নিয়ে যাচ্ছেন এই ব্যাটসম্যান। তাঁকে ঘিরে নতুন স্বপ্ন দেখছিল গোটা ক্রিকেট বিশ্ব। সেই সময়ে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে ভাবা হত তাঁকে। ১৯৩২ সালে তাঁর বয়স যখন মাত্র ২৬ বছর। যেটা টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য একজন ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে ভালো সময় তখনই সব থমকে গেল। সেই সময় টেস্ট ও কাউন্টি দুই জায়গাতেই রানের পর রান করে যাচ্ছেন তিনি। তখনই হঠাৎ ডাক্তাররা তাঁর হৃদরোগ খুঁজে পেলেন।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ দুই ইনিংসে তাঁর রান সংখ্যা ১০৯ ও ৬৩। এরপর আর কখনোই টেস্ট খেলা হয়নি তাঁর। ডাক্তাররা একেবারেই নিষেধ করে দিয়েছিলেন ওই বাইশ গজে নামতে। ফলে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই থেকে যায় তাঁর কালোর্ত্তীর্ণ হবার যাত্রা। হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ পরিসংখ্যান থাকতে পারতো এই ব্যাটসম্যানের।

অবশ্য যেই ১২ টি টেস্ট খেলেছিলেন তাতেই নিজের দাগ রেখে গিয়েছেন দুলীপ। ১২ টেস্টে তাঁর ঝুলিতে আছে তিনটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি। ১৯ ইনিংসে ৫৯.৫২ গড়ে করেছেন ৯৯৫ রান।

এছাড়া স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও অন্যতম সেরা ছিলেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর হাতে ধরা পড়েছে ২৫৬ টি ক্যাচ। তাঁর খেলা ১২ টেস্টেও তিনি নিয়েছিলেন ১০ টি ক্যাচ।

১৯৩২ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর এক বছর পরই মারা গিয়েছিলেন তাঁর চাচা রঞ্জিতসিংজি। অবসরের পর অনেকটা সময় ভারত ও ইংল্যান্ডের নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। মারা যাওয়ার কয়েকমাস আগে তিনি অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিলেরও সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বোম্বেতে মৃত্যুবরণ করেন এই কিংবদন্তি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...