কিসের সিনিয়র-জুনিয়র!
পাইলট কিপিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন মুশফিককে; যে মুশফিক তাঁকে জাতীয় দল থেকে ছিটকে দিতে চলেছেন। রাবারের ব্যাট দিয়ে পাইলটের আঘাত করা বল ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে গ্লাভসে নিচ্ছেন মুশফিক। একটা বল মিস করায় শক্ত একটা ঝাড়িও দিলেন পাইলট।
আজ একটা ছবি দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো।
সদ্যই টি-টোয়েন্টিতে কিপিং ছেড়ে দেওয়া মুশফিক দারুণ নিবিঢ় চিত্তে কিপিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন নুরুল হাসান সোহানকে!
এই ছবিটা অনেককেই আঘাত করার কথা। যারা বাংলাদেশ দলে সিনিয়র-জুনিয়র বিভাজন খুজে পাচ্ছেন, যারা বিভিন্নরকম সিন্ডিকেটবাজী করার চেষ্টা করছেন; তাদের জন্য এই দৃশ্যটা হজম করা কঠিন। তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তো এই এক ছবিই ধ্বসিয়ে দেওয়ার কথা।
আমার আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সেখানেও এই মুশফিক ছিলেন।
সময়টা ২০০৬ সালের শেষ দিকের কোনো একটা মাস সম্ভবত।
মুশফিকুর রহিম তখন জাতীয় দলে; তবে স্রেফ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। কিপিং করছেন তখনও বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা কিপারদের একজন খালেদ মাসুদ পাইলট। দেশ জুড়ে দারুণ বিতর্ক, কার কিপিং করা উচিত?
পাইলট, নাকি মুশফিক?
আমরা প্রথম আলো থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘স্টেডিয়াম’ নামে পরে বিলুপ্ত ফিচার পাতায় পরস্পরের সম্পর্কে পাইলট ও মুশফিকের মূল্যায়ন নিয়ে একটা বড় ফিচার করবো। দু’জনকেই ফোন দিলাম। দু’জনই সময় দিলেন পরদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে।
আমি একটা যুদ্ধ কাভারের মানসিকতা নিয়ে মিরপুর গেলাম। কল্পনা করছিলাম, তারা পরস্পরকে দেখে মুখ কালো করে ফেলবেন, আড়ষ্ট উত্তর দেবেন এবং কোনোক্রমে উত্তর দিয়ে উঠে চলে যাবেন।
আমি যে তখনও শিক্ষানবীশ এবং দুনিয়ার কিছুই জানি না, তার প্রথম প্রমাণ পেয়েছিলাম সেদিন। মাঠে ঢুকে দেখি, পাইলট ভাই মুশফিকের কাধে ভর দিয়ে একটা পা ভাজ করে দাড়িয়ে আছেন। দু’জন এক মনে কম্পিউটার অ্যানালিস্ট নাসু ভাইয়ের কথা শুনছেন; নাসির আহমেদ নাসু নিজে পাইলটপূর্ব যুগের দেশসেরা উইকেটরক্ষক।
আমার চমকের আর শেষ হয় না।
নাসু ভাই বললেন দু জনকে প্র্যাকটিসে যেতে। সেই প্র্যাকটিসটা আমার জন্য একটা শিক্ষা সফরের মতো ছিলো। পাইলট কিপিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন মুশফিককে; যে মুশফিক তাকে জাতীয় দল থেকে ছিটকে দিতে চলেছেন। রাবারের ব্যাট দিয়ে পাইলটের আঘাত করা বল ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে গ্লাভসে নিচ্ছেন মুশফিক। একটা বল মিস করায় শক্ত একটা ঝাড়িও দিলেন পাইলট।
লম্বা অনুশীলন শেষ করে দু জন হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। পাইলট ভাই আমাকে চিনতেন। এক গাল হেসে বললেন, ‘আসো, দেবুদা। ইন্টারভিউ দেই। আসো, দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ লাগাও।’
আমি সেদিন বুঝেছিলাম যে, ক্রিকেট দল সম্পর্কে আমাদের বাইরের লোকেদের বোঝাপড়ার অনেক ঘাটতি আছে। আমরা বাইরে বসে সিনিয়র-জুনিয়র, বিকেএসপি-নন বিকেএসপি অনেকরকম লড়াই কল্পনা করি। আসলে ভেতরে ভেতরে এরা আমাদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি পরষ্পরের বন্ধু-ভাই।
আমার মনে আছে সাকিব আর মাশরাফির কথা।
২০১১ বিশ্বকাপের পরপর সারা দেশ এই দু জনকে পরষ্পরের শত্রু বানিয়ে দিয়েছিলো। স্বভাবতই সেই আগুনে ঘি ঢেলেছিলো সংবাদ মাধ্যমগুলো। কিন্তু সেই ‘উত্তাল’ অবস্থায় আমি তাদের দু জনকে কাঁধে হাত দিয়ে হাটতে দেখেছি। আমি মাশরাফির ইনজুরিতে সাকিবকে দেখেছি বেসামাল হয়ে পড়তে, সাকিবের হাত ফেটে যাওয়ায় মাশরাফিকে প্রায় কেঁদে ফেলার মত অবস্থায় দেখেছি।
হ্যা, একটা প্রতিযোগিতা তো আছেই; থাকবেই।
নিশ্চয়ই সোহানের সাথে মুশফিকের একটা লড়াই আছে। সেটা হলো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই; নিজেকে যোগ্যতর প্রমানের লড়াই। এই লড়াইটা ভেতরে ভেতরে থাকে। এটাই মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সামনে এগিয়ে যেতে। এই লড়াইটা কখনো সামনে আনতে নেই। ওতে স্বাস্থ্যকর লড়াই হাস্যকর হয়ে পড়ে। ঠিক এই ভুলটাই রাসেল ডমিঙ্গো করেছিলেন। তিনি মুশফিক আর সোহানকে মাঠে লড়াইতে নামাতে চাচ্ছিলেন। ভাই, ওটাকে সেমসাইড বলে।
লড়াই যা আছে, তা পেছনে। মাঠে তো তো আমরা পরষ্পরের বিপক্ষে লড়তে পারি না। মুশফিক তাই প্রকৃত যোদ্ধার মত সে লড়াই থেকে নাম তুলে নিয়েছেন। তাতে যে সোহানের সাথে সম্পর্ক এতোটুকু ফিকে হয়নি, তার প্রমাণ আজকের ছবিটা।
ইদানিং আরেকটা কথা বলা হচ্ছে যে, রাসেল ডোমিঙ্গো সিনিয়রদের বিপক্ষে লেগেছেন।
এটাও হাস্যকর বলে আমার মনে হয়। প্রথমত ডোমিঙ্গোর চান্দিকা ব্যক্তিত্ব হাতুরুসিংহের মত প্রখর নয়। তিনি এরকম কোনো পরিকল্পনা আটার মত অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এরকম কিছু করার কোনো লক্ষনও আমি দেখি না।
যেটা হচ্ছে, তা হলো পারফরমার-নন পারফরমার একটা বাছাই চলছে। এটা ফাইন। পারফরম করতে না পারলে তারুন্য দিয়েও কারো টিকে থাকার যুক্তি নেই। আবার পারফরম করলে তিনি সিনিয়র হলেও টিকে থাকবেন।
উল্টোটাও সত্যি।
পারফরম করতে না পারলে সিনিয়রটি কাউকে গ্যারান্টি দেবে না। তাকে সরে যেতেই হবে। শচীন টেন্ডুলকারদের জায়গাও কোনো না কোনে সময় বিরাট কোহলিরা নিয়ে ফেলবেন – এটাই নিয়ম প্রকৃতির।
তবে একটু কথা থেকে যায়। সিনিয়ররা তো হাওয়ায় সিনিয়র হননি। প্রত্যেকের এক যুগের বেশি অবদান আছে জাতীয় দলের জন্য। ফলে তাদের কিছু প্রটোকল অনুযায়ী সম্মান প্রাপ্য। যেটা সব দলে দেওয়া হয়। সিনিয়র ক্রিকেটারদের বাদ দেওয়ার আগে, একাদশের বাইরে রাখার আগে তাদের সাথে আলোচনা করা হয়। আশা করি, বাংলাদেশ দলেও সেই সম্মানটা সিনিয়ররা পাচ্ছেন। এর বাইরে সিনিয়র-জুনিয়র প্রভেদ বলে কিছু থাকার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ মানে একটা দলই আমরা বুঝি। এর ভেতরে আর কোনো দলের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
আমাদের অভিজ্ঞ সেনানীরা আস্তে আস্তে সরে যাবেন। তাদের জায়গা নেবেন তরুনতর খেলোয়াড়রা। ক্রিকেট এগিয়ে যাবে। অভিজ্ঞ বলে কেউ সারা জীবন খেলবেন না, আবার তরুণ বলে কেউ পারফরম না করেও টিকে থাকবেন না।
বিচার হোক একটাই-পারফরমার, নাকি নন পারফরমার।