গুগলে ‘Leonidas’ লিখে সার্চ দিলে হলিউডের নায়ক জেরাল্ড বাটলারের হাজারো ছবি চলে আসবে। কেননা ‘৩০০’ নামক সিনেমায় গ্রীক যুদ্ধবাজ রাজা লিওনিদাসে চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এবার ‘Leonidas bicycle kick’ লিখে সার্চ দিন। পর্দায় ভেসে উঠবে ফুটবলের অন্যতম আইকোনিক একটি সাদা-কালো ছবি, যেখানে আমাদের এই লেখার কেন্দ্রীয় চরিত্র তাঁর বিখ্যাত বাইসাইকেল কিক করে গোল করছেন।
আসুন এই মানুষটির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই- তাঁর নাম লিওনিদাস দ্য সিলভা, অবশ্য তিনি ব্ল্যাক ডায়মন্ড কিংবা রাবারম্যান নামেও পরিচিত ছিলেন। কয়েক দশক পর ব্ল্যাক পার্ল নামের আরেকজন লিজেন্ডারি ফুটবলার আসার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার, ব্রাজিলের প্রথম সুপারস্টার!
লিওনিডাস জন্মেছিলেন রিও ডি জেনিরো’র একটি ছোট্ট, নিরিবিলি, মফস্বল শহরে। তারিখটি ছিল ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩। একে তো কৃষ্ণাঙ্গ পাশাপাশি ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন ছোট-খাটো গড়নের। ফলে, প্রথম দেখায় তাঁকে কেউই তেমন পাত্তা দিত না। তবে, সময়ের সাথে সাথে তিনি এমন একজন জাদুকরী ফুটবলার হয়ে ওঠেন যে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে নিজের নাম চিরস্থায়ী করে নিয়েছেন। একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ম্যাচ মিলিয়ে গোল করেছেন পাঁচ শতাধিক।
১৯৩১ সালে তিনি ফুটবল ভক্তদের নজরে আসেন। তখন তিনি যোগ দিয়েছেন স্থানীয় বনসুচেসো ক্লাবে। এই ক্লাবে খেলাকালীন প্রথমবারের মত বাইসাইকেল কিক করে সবার মন জয় করে নেন। ফুটবলের ইতিহাসে ‘কে প্রথম বাইসাইকেল করেছে’- তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে, লিওনিডাসই যে এটাকে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে অর্থাৎ ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচে বাইসাইকেল কিকের মাধ্যমে গোল করে তিনি সারা বিশ্বকে আক্ষরিক অর্থেই হতভম্ব দেন।
ব্রাজিলের হয়ে লিওনিডাসের অভিষেক হয় ১৯৩২ সালে। অভিষেক ম্যাচেই সে সময়ের মহা-প্রতাপশালী উরুগুয়ের বিরুদ্ধে দুই গোল করে নিজের আগমনী বার্তা জানান! ১৯৩৪ সালে অর্থাৎ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরটি ছিল ব্রাজিলের আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা মোচনের মিশন। কেননা, শিরোপা প্রত্যাশী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বকাপের প্রথম আসরে তারা প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। ১৯৩৪ এর দলটি ছিল আগের বারের চেয়েও দুর্দান্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারও তারা স্পেনের কাছে ১-৩ গোলে হেরে প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেয়। একমাত্র গোলটি করেন লিওনিদাস।
পরের বিশ্বকাপ, অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে তিনি আরও পরিণত হয়ে খেলতে যান। ততদিনে খেলেছেন নামকরা ভাস্কো দা গামা এবং বোতাফগো ক্লাবের হয়ে এবং ফ্ল্যামিঙ্গো ক্লাবে যোগ দেয়ার কথা-বার্তা চলছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে সে সময়ের ব্রাজিলিয়ান সমাজে যা ছিল প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার!
১৯৩৮ সালের ব্রাজিল দলের আক্রমণভাগ ছিল সে সময়ের সেরা। আক্রমণভাগে ছিলেন চারজন ভয়ঙ্কর খেলোয়াড়-লিওনিডাস, রোমিউ, পেরাসিও এবং রবার্তো। ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচই শুরু হয় গোলের বন্যা দিয়ে-পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটি তারা ৬-৫ গোলে জিতে নেয়। ম্যাচে লিওনিদাস হ্যাটট্রিক করেন এবং তাঁর সেদিনের পারফরমেন্স এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা হিসেবে গণ্য করা হয়!
কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের খেলা পড়ে চেকোস্লোভাকিয়ার সাথে। প্রচণ্ড রাফ এন্ড টাফ সেই ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র হয়। তখনকার নিয়মানুযায়ী পরেরদিন আবার খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফিরতি ম্যাচটি ব্রাজিল ২-১ গোলে জিতে নেয়। উল্লেখ্য, লিওনিদাস উভয় ম্যাচেই গোল করেন। নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি না হলে আবার খেলা হবার এটাই ছিল শেষ উদাহরণ।
সেমিফাইনালে এসে ব্রাজিলের দুর্দান্ত পথ চলাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক মোড় নেয়। প্রতিপক্ষ ইতালি স্বাগতিক হলেও সে সময়কার ব্রাজিলের সামনে নিতান্তই ‘পুঁচকে’ একটি দল। কিন্তু মহা-বিবেচক (জি, ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত হয়েছে!) ব্রাজিল ম্যানেজার অ্যাডিমার পিমেন্তা ঠিক করলেন সেই ম্যাচে তিনি লিওনিডাস এবং তাঁর আরেক সতীর্থ টিম’কে বিশ্রাম দেবেন। দুজনেই ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে।
অনেকেই বলে এটা ছিল ম্যানেজারের কৌশলগত ভুল। তবে, একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে এই সিদ্ধান্তটি আসলে তখনকার ফ্যাসিস্ট ইতালিয়ান সরকারকে খুশি রাখার কৌশল ছিল!
যাই হোক, ম্যাচে রোমিউ নিজের সর্বস্ব উজাড় করেও শেষ রক্ষা করতে পারেন নি। আসলে লিওনিডাসের অভাব কাউকে দিয়েই পূরণ করা সম্ভব ছিল না। ম্যাচটি ব্রাজিল ১-২ গোলে হেরে যায়! শেষ পর্যন্ত তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে লিওনিডাস আবার খেলতে নামেন এবং সারাবিশ্বকে দেখিয়ে দেন আগের ম্যাচটি নিছকই একটি অঘটন ছিল। সুইডেনকে তারা পরাজিত করে ৪-২ ব্যবধানে।
সাত গোল করে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোল-স্কোরার হবার গৌরব অর্জন করেন লিওনিডাস। শুধু তাই নয়-বিশ্বকাপে খেলা প্রতিটি ম্যাচেই গোল করার অনন্য রেকর্ড গড়েন। এখন পর্যন্ত তিনি ছাড়া এই রেকর্ড কারও নেই। পেলে, ফন্টেইন, জার্ড মুলার, ম্যারাডোনা, রোনালদো থেকে শুরু করে ক্লোসা, মেসি বা পর্তুগালের রোনালদোও এই রেকর্ডের ধারেকাছেও নেই! এ থেকেই বোঝা যায় কতটা বিস্ময়কর এবং অভাবনীয় এই রেকর্ড!
১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপের পর লিওনিডাস আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন, ফ্ল্যামিঙ্গো ক্লাবের হয় নিজের ৩য় প্রাদেশিক শিরোপা জিতে নেন। ১৯৪৩ সালে ক্লাব বদলে সাও পাওলোয় যোগ দেন। এই ক্লাবের হয়ে পরের সাত মৌসুমের মধ্যে পাঁচবারই শিরোপা ছিনিয়ে নেন। কিন্তু, দুঃখের বিষয় আর কখনই বিশ্বকাপে খেলা হয়ে ওঠেনি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারাবিশ্বের শুধু মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষতিই করে নি-পুরো পৃথিবীর ক্রীড়াঙ্গনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৫০ সালে তিনি অবসর নেন, বিশ্বকাপ ফুটবলের ঠিক আগে! কেন কে জানে?! অথচ ব্রাজিল সেবার স্বাগতিক ছিল, সেবারই তারা প্রথমবারের মত ‘ফাইনালে’ (অঘোষিত) উত্তীর্ণ হয় কিন্তু আবারও শিরোপা জিততে ব্যর্থ হয়! প্রথম শিরোপার জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরও দীর্ঘ আটটি বছর।
যাই হোক, ফুটবল থেকে বিদায় নেয়ার পর তিনি কিছুদিন সাও পাওলো’র কোচ হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু এরপর ফুটবল ছেড়ে একেবারে ভিন্ন এবং অদ্ভুত কিছু পেশায় জড়ান। যেমন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, রেডিও ধারাভাষ্যকার, আসবাবপত্র বেচা-কেনার দোকানদার ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালে তাঁর আলঝেইমার রোগ ধরা পড়ে। তবে, প্রায় তিন দশক ধরে তিনি মারাত্মক অসুখটির সাথে লড়াই চালিয়ে যান, যেমন-ভাবে একসময় ফুটবল মাঠে লড়তেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে হার মেনে নেন এবং ৯০ বছর বয়সে মারা যান।
সমস্যা হচ্ছে মানুষ ট্র্যাজিক হিরোদের চেয়ে সফল হিরোদেরকেই মনের মণিকোঠায় জায়গা দিতে পছন্দ করে না। আর ব্রাজিলের মানুষ তো এ ব্যাপারে আরেক কাঠি সরেস! আর এজন্যই লিওনিদাসের কথা আজ অনেকেই জানে না। এমনকি হলিউড সিনেমার অতিরঞ্জিত চরিত্রও আজ তাঁর চেয়ে বেশি জনপ্রিয়! অথচ, লিওনিদাস দ্য সিলভা শুধু ব্রাজিলের প্রথমই নন, বিশ্ব ফুটবলেরও অন্যতম সেরা একজন সুপারস্টার। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের ম্যাজিশিয়ান!