হ্যারি কেন, দুর্ভাগা গোলমেশিন

একুশ শতাব্দীর শুরুর সময়, আর্সেনালের একাডেমি থেকে বের করে দেয়া হয় আট বছরের এক ইংলিশ শিশুকে। কারণ হিসেবে বলা হয় সে স্থুলকায় আর পরিশ্রমী নয়। কিন্তু ২০১৫ সালের নভেম্বরে আর্সেনালের কিংবদন্তি আর্সেন ওয়েঙ্গার স্বীকার করেন ছেলেটিকে ছেড়ে দেয়া ক্লাবের ইতিহাসের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

আর্সেনালের দরজা থেকে ফিরে আসা সেই ইংরেজ বর্তমানে প্রথম সারির ফুটবলারদের মধ্যে একজন। তিনি এখন রবার্ট লেওয়ানডস্কি, করিম বেনজেমাদের মতই বিশ্বের সেরা নাম্বার নাইনদের মধ্যে অন্যতম সেরা। ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পথেও বেশ এগিয়ে আছেন।

আপনি কি ভাবতে পারছেন, সেদিন আসলে আর্সেনাল কাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলেই দেয়া যাক, তিনি আর কেউ নন; ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক হ্যারি এডওয়ার্ড কেন।

গত কয়েক বছরে ইউরোপীয় ফুটবলে যারা আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের মধ্যে উপরের দিকেই থাকবে হ্যারি কেনের নাম। প্রতি মৌসুমে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যুদ্ধে এই স্ট্রাইকার সফল। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে নিজেকে আরো শাণিত করে তুলেছেন। প্রতিভা আর পরিশ্রমের মিশলে তৈরি হয়েছে একজন হ্যারি কেন।

১৯৯৩ সালের ২৮শে জুলাই ইংল্যান্ডের ওয়ালহ্যামস্টো শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হ্যারি কেন। বেড়ে উঠেছিলেন চিংফোর্ডে। বাবা প্যাট কেনকে কোচ বানিয়েই শুরু হয়েছিল হ্যারি কেনের ফুটবল প্রশিক্ষণ। এরপর নিজের প্রিয় ক্লাব আর্সেনালের একাডেমিতে যোগ দেন তিনি, কিন্তু সেই গল্পের করুণ সমাপ্তি জানা হয়ে গিয়েছে সবার।

আর্সেনাল থেকে ফিরে আসার পর স্থানীয় ক্লাবগুলোর হয়ে খেলা শুরু করেন হ্যারি কেন। এর মাঝে ওয়াটফোর্ডের এক স্কাউটের চোখে পড়ে কিশোর হ্যারির প্রতিভা। ওয়াটফোর্ডের একাডেমিতে স্থান হয় তাঁর। অতপর সেখান থেকেই কেনের গন্তব্য হয়ে যায় টটেনহ্যাম হটস্পার। কয়েকটি লোন স্পেন বাদ দিলে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় স্পার্সদের জার্সি গায়ে কাটিয়েছেন ইংলিশ ক্যাপ্টেন।

২০০৪ সালে টটেনহ্যাম হটস্পারের অনূর্ধ্ব-১৮ দলে ছিলেন হ্যারি কেন। এরপর পাঁচ বছর যুব দলে থাকার পর ২০০৯ সালে মূল স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি। তবে অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো কিছু সময়, শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে ইউরোপা লিগের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে মাঠে নামেন হ্যারি কেন।

অভিষেকের পর থেকে প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তরুণ হ্যারি কেন এখন অভিজ্ঞ আর পরিপক্ব। এই দীর্ঘ যাত্রায় স্পার্সদের হয়ে মোট ৩৮৫টি ম্যাচ খেলেছেন কেন। গোল করেছেন ২৪৭টি, আর করিয়েছেন আরো ৫৯টি। কোরিয়ান তারকা সনের সঙ্গে জুটি গড়ে প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডার ত্রাস হয়ে উঠেছেন তিনি।

এছাড়া ধারে থাকার সময় লেস্টার সিটি, মিলওয়াল এফসি এর মত দলেও খেলেছেন। সবমিলিয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারে ৪৬৪টি ম্যাচ খেলা হ্যারি কেন জালের দেখা পেয়েছেন ২৭৪ বার। এবং অ্যাসিস্ট করেছেন ৭৫টি।

২০১০ সাল থেকেই জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলেন হ্যারি কেন। অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-২০ এর বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলার পর ২০১৫ সালে জাতীয় দলে ডাক পড়ে এই স্ট্রাইকারের। এরপর থেকে ইংলিশদের আক্রমণভাগের বড় দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই আছে।

এখন পর্যন্ত ৭৩ ম্যাচে ৫০ গোল করা কেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল দাতা। তাঁর সামনে আছে শুধুই ৫৩ গোল করা ওয়েইন রুনি। ধারনা করাই যায়, খুব শীঘ্রই ইংরেজদের সর্বকালের সেরা গোলদাতা হয়ে যাবেন টটেনহ্যাম তারকা।

এত এত গোল দেখে ভাবতে পারেন হ্যারি কেনের ট্রফি ক্যাবিনেট বোধহয় পরিপূর্ণ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস বলতেই হয়, দলীয় অর্জনের হিসেবে হ্যারি কেনের হাতটা বড্ড শূন্য। অথচ প্রিমিয়ার লিগে তিনবার গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনি, ২০১৮ বিশ্বকাপেও জিতেছেন সোনালী জুতা। প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার হয়েছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু টটেনহ্যাম তাকে দিতে পারেনি কিছুই।

হ্যারি কেন তাঁর সবটা দিয়েও পারেননি একবার শিরোপা মঞ্চে উঠতে। দায়টা দলের অন্যদের, নাকি কেনের অতিমানবীয় পারফরম্যান্স যথেষ্ট নয় – সেই উত্তর এখনো অজানা।

একজন ফুটবলার হিসেবে কেইনের অর্জন যেকোনো স্ট্রাইকারের জন্য ঈর্ষণীয়। গ্যারি লিনেকারের মত কিংবদন্তিও সেটা জানেন। কিন্তু হ্যারি কেন যেখানে নিজের উন্নতিতে আরো মনোযোগী হয়ে উঠেছেন, সেখানে টটেনহ্যাম হাঁটছে উল্টো পথে।

কিছু ফুটবলার গ্রেট হয়েই জন্ম নেয়। ক্যারিয়ারের প্রতিটি সময় ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ তাদের সাথেই থাকে। কিন্তু হ্যারি কেন হয়তো তাদের মত কেউ না। তাই গত এক দশক ধরে লড়াই করেও গ্রেটনেস পাওয়া হয়নি তাঁর।

হ্যারি কেনের বয়সটা এখন ২৮, সামনে এখনো অন্তত দুইটি বিশ্বকাপ বাকি। ক্লাব ক্যারিয়ারেও সম্ভাবনা আছে অনেক কিছু জেতার। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ দল তাকে দিবে কি না সেটিই প্রশ্ন হয়ে রইলো। শিরোপা জিততে পারলে তো ভালো, না পারলে ট্র্যাজিক হিরো হয়েই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন হ্যারি কেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link