তিনিই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র মানুষ হবেন যিনি তাঁর জীবদ্দশায় ব্রিটিশ সাইকো অ্যানালাইটিক্যাল কাউন্সিল ও মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইংল্যান্ডের একজন ক্রিকেটার হিসেবে হয়তো তাঁকে কেউ মনেও রাখতো না। তবে অধিনায়কত্ব দিয়ে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন গ্রেটদের কাতারে। ইংল্যান্ড তো বটেই তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। মাইক ব্রিয়ারলি অধিনায়কত্বকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে।
১৯৪২ সালের ২৮ এপ্রিল মিডেলসেক্সের হ্যারো এলাকায় জন্ম গ্রহন করেন জন মাইকেল ব্রিয়ারলি। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার। তবে ব্রিয়ারলির কাছে পড়াশোনার গুরুত্ব ছিল সবার আগে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ১৯৬১-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত দলটির হয়ে খেলেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ক্যামব্রিজ দলের অধিনায়কত্বও করেন তিনি। এই সময়ে তিনি মিডেলসেক্সের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলাও শুরু করেন। তবে পড়াশোনার জন্য ১৯৬৯ ও ১৯৭০ এই দুই বছর ক্রিকেট থেকে বিরতি নেন তিনি।
তবে প্রায় ৩০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসেও মিডলসেক্সের অধিনায়ক হিসেবে ক্রিকেটে ফেরেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে চার বার তাঁর নেতৃত্বে কাউন্টি জিতে মিডেলসেক্স। ব্যাটসম্যান হিসেবে সেরাদের কাতারে না থাকলেও তাঁর ক্রিকেট মেধা বিবেচনায় নিয়ে ৩৪ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট অভিষেক ঘটে তাঁর। এরপর মাত্র চার বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে খেলেন ৩৯ টেস্ট। ২২.৮৮ গড়ে করেছেন ১৪৪২ রান। এই পরিসংখ্যান দেখেই আপনি ব্রিয়ারলিকে মাপলে ভুল করবেন।
তাঁর খেলা ৩৯ টেস্টের ৩১ টিতেই তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। তারমধ্যে ১৮ টেস্টেই জয় পায় ইংল্যান্ড। ব্রিয়ারলির সময়ে তাঁরা ম্যাচ হেরেছিল মাত্র চারটি। অতএব অধিনায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন সেরাদের সেরা। মাঠে তাঁর অদ্ভুত সব সিদ্ধান্তই ম্যাচ জিতিয়ে দিতো ব্রিয়ারলিকে। হয়তো কিছু কিছু ভাগ্যের জন্যও জিতে যেতেন তবে নিয়ম করে এই অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহসই বা কয়জন রাখেন।
অবশ্য খালি চোখে তাঁর অনেক কিছুই অদ্ভুত মনে হলেও তাঁর বেশিভাগের পিছনেই ছিল ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা। অসাধারণ ক্রিকেট ব্রেইনের পাশাপাশি, ক্রিকেটারদের থেকে সেরাটা বের করে আনতেও তাঁর জুড়ি নেই। তাছাড়া মাঠে তাঁর অসাধারণ সব সিদ্ধান্ত ও মাঠের বাইরে সব ধরনের মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁকে করেছিল অনন্য।
সেই সময়ে তিনিই প্রতিপক্ষ এবং প্রতিপক্ষের প্রতিটি ক্রিকেটারকে নিয়ে বিশ্লেষণ করা শুরু করেছিলেন। ব্যাটসম্যানের ধরণ দেখে ফিল্ডিং সাজানো, ব্যাটসম্যান ব্যাটের গ্রিপ কী করে ধরছেন তাঁর উপর ভিত্তি করে স্লিপের পজিশন ঠিক করা, এমনকি বোলার রান আপে থাকা অবস্থাতেও ফিল্ডিং পরিবর্তন করা ছিল তাঁর অধিনায়কত্বের কিছু উদাহরণ। এছাড়া ফিল্ডারদের স্পিড, ডানহাতি অথবা বামহাতি এসব বিবেচনা করেও তাঁদের ফিল্ডিং পজিশন ঠিক করতেন।
ব্যাটিং লাইন আপও ছিল বৈচিত্র। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং অর্ডার চেঞ্জ করতেন প্রায়শই। আধুনিক ক্রিকেটে এগুলো হয়তো খুব নিয়মিত ব্যাপার। তবে সেই সময়ে যখন প্রযুক্তি এই অবস্থায় ছিল না তখন ব্রিয়ারলিই ছিলেন একমাত্র ভরসা। আমরা নিয়মিত যেই চিত্র গুলো মাঠে দেখি সেগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই।
একবার কাউন্টি ক্রিকেটে এক ম্যাচে প্রথম ইনিংসে শূন্য রানেই ডিক্লেয়ার দিয়ে দেন উইকেটের সুবিধা নিবেন বলে। তারপর বিপক্ষ দল ৪৯ ও ৮৭ রানে অল আউট হয়ে গেলে চতুর্থ ইনিংসে ১ উইকেটেই ১৩৭ রান করে তাঁর দল। অতএব প্রথম ইনিংস ব্যাট না করার সাহস দেখিয়েও জয় পায় ব্রিয়ারলিরা।
সব মিলিয়ে তিনিয়ে ক্যাপ্টেন্সি একটা আর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং নির্দ্বিধায় তিনিই সবচেয়ে বড় আর্টিস্ট। অবসরে যাবার পর তিনি ‘দ্যা আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি’ নামে একটি বই লিখেন। তাছাড়া বর্তমানে তিনি ব্রিটিশ সাইকো অ্যানালাইটিক্যাল কাউন্সিলের সাইকো থেরাপিস্ট হিসেবে নিয়োজিত আছেন।