২০০৫ অ্যাশেজ।
অস্ট্রেলিয়া নিশ্চয়ই এই স্মৃতি মনে করতে চাইবে না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার একজন মানুষের কাছে হেরে যাওয়া ওই অ্যাশেজের কথা ভোলা কঠিন।
সেটা ছিলো অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের আরেকটা টেস্ট। সিরিজের চতুর্থ টেস্ট শুরু হলো নটিংহ্যামে। অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে অভিষেক হলো ২২ বছর বয়সী বিশালদেহী এক তরুণ ফাস্ট বোলারের। চওড়া কাঁধ, সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতা এবং ভয়ঙ্কর গতি। হ্যাঁ, গতি দিয়েই হতভম্ব করে ফেললো সে সবাইকে।
লাইন-লেন্থে তখন খুব নিয়ন্ত্রন ছিলো না। তারপরও এই প্রবল গতি আর সিলিং অ্যাকশনের জন্য সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠলো- এ তো জেফ থমসন!
হ্যাঁ, থমসন নিজেও মুগ্ধ হলেন। বললেন, ছেলেটা থাকতে এসেছে।
না, থমসন জীবনে অনেক সঠিক কথা বললেও এই বেলা ভুল হয়েছিলো তার। আসলে দুনিয়ার সবারই ভুল হয়েছিলো। শেন ওয়ার্ন, ব্রেট লি থেকে মাইকেল ভন; সবাই বলেছিলেন, ছেলেটা টিকতে এসেছে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে জ্বলে উঠেই পুড়ে নিশ্বেষ হয়ে গেলো সে। মাত্র পাঁচ বছরেই সব ধরণের ক্রিকেট থেকে দূরে চলে গেলো। আর এর মাঝে গতি দিয়ে এই দুনিয়ার বুকে নিজের নামটা খোদাই করে রেখে গেলো। বলে গেলো, আমি এসেছিলাম।
হ্যা, এই হঠাৎ জ্বলে উঠে ফুরিয়ে যাওয়া বোলারটি শন টেইট। দুনিয়ার দ্বিতীয় দ্রুততম ডেলিভারিটি করা শন টেইট, ২০০৭ বিশ্বকাপের অন্যতম নায়ক শন টেইট এবং রহস্যের মত ফুরিয়ে যাওয়া শন টেইট।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ছেলে টেইট জাতীয় দলে আসার আগেই এই গতির কারণে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় অন্তত অনেক কথা হচ্ছিলো তাঁকে নিয়ে। নেটে এসে যখন জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে কুপোকাঁত করে ফেললেন, তখন অস্ট্রেলিয়া দলের তারকারাও হতভম্ব হয়ে গেলেন।
শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, ‘ওকে নেটে দেখার পর আমার মনে হয় না পৃথিবীর কোনো ব্যাটসম্যান ওর বল খেলতে চাইবে।’
আসলেই তাই। ডেনিস লিলি দেখতে এসেছিলেন তার বোলিং । ইংল্যান্ড সফরের জন্য তৈরি হতে থাকা টেইটকে দেখে পঞ্চমুখ হয়েছিলেন তিনি। বিবিসি উদ্ধৃত করেছিলো লিলিকে, ‘ইংলিশদের নাকের কাছ থেকে বল পাঠানোর মত সব ধরণের শক্তি ও সম্পদ এই ছেলেটার আছে।’
তা টেইট করলেন বই কী!
অভিষেকে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। বলের ওপর কন্ট্রোল মোটেও খুব ভয়ানক ছিলো না। তারপরও নিয়মিত তাকে ১৫৬ কিলোমিটারের ওপর বল করতে দেখাটা অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য বড় একটা প্রাপ্তি ছিলো।
২০০৭ সালে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অভিষেক হলো। ২০০৭ বিশ্বকাপে ২৩ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আরেকটা শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। সে বছরই নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ও কোচ টেইটের বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে প্রশ্ন খুব হালে পানি পায়নি। ২০০৮ সালে প্রথম ইনজুরিতে পড়ে সুপার সিরিজ মিস করেন। আর ওই বছর থেকেই টেইটের এলেমেলো সময় শুরু।
সে বছর তিনি ক্রিকেট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি নিলেন মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কারণে। কার্যত ওই জানুয়ারির পর আর টেস্ট ক্রিকেটে ফেরা হয়নি; টেইটই ফিরতে চান। ২০০৯ সালে যখন ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরলেন, তখন বললেন লংগার ফরম্যাট তার জন্য নয়। তিনি পেরে উঠছেন না।
এরপর ক্রিকেটটাই আর খুব বেশী দিন পেরে ওঠেননি। ২০০৯ আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালস বিপুল টাকায় কিনেছিলো তাকে। কিন্তু ইনজুরির কারণে নাম প্রত্যাহার করে নেন তিনি। ওই বছরই প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটও ছেড়ে দেন। আসলে শরীর চাপ নিতে পারছিলো না। দীর্ঘদেহী হলেও সিলিং অ্যাকশনে প্রবল গতির চাপ তার শরীর নেওয়ার মত ছিলো না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের জন্য দলে শেষ মুহুর্তে যোগ করা হয় টেইটের নাম। এই ইংল্যান্ড থেকে শুরু হয়েছিলো ৫ বছর আগে। আর এখানেই ইতিহাস করলেন এবার।
লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ছুড়লেন ১৬১.১ কিলোমিটার গতির এক গোলা। হয়ে গেলো ইতিহাস। এটা ছিলো ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম ডেলিভারি। সবার আগে রইলেন কেবল শোয়েব আখতার।
কিন্তু এই গতির প্রদর্শনী টেইটের ক্যারিয়ার বাঁচাতে পারলো না। ২০১১ সালে আহমেদাবাদে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেটা তার ক্যারিয়ারের শেষ হয়ে রইলো। ঘরোয়া ক্রিকেটেও আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারেননি খুব একটা।
২০১৬ সালে কার্যত শেষ খেলেছেন। ২০১৭ সালে বিগ ব্যাশে একটা ম্যাচ খেলেছিলেন। ওটাই শেষ প্রতিদ্বন্ধীতামূলক ম্যাচ। এর পর সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষনা দিয়ে দেন।
টেস্ট খেলেছেন সাকল্যে ৩টি; ৫ উইকেট। এ ছাড়া ৩৫ ওয়ানডেতে ৬২ এবং ২১ টি-টোয়েন্টিতে শিকার তার ২৮ উইকেট। এতেই সন্তুষ্ট রইতে হলো শন টেইটকে। পারলেন না থমসন হয়ে উঠতে।
ধুমকেতুর মতো এসেছিলেন, প্রবল আলো ছড়িয়ে জ্বলে উঠেছিলেন এবং ফুরিয়ে গেলেন তার চেয়েও বিস্ময়করভাবে। এক হেয়ালি হয়ে রইলেন ক্রিকেটের।