২১ জুন, বছরের সবচেয়ে বড় দিন। ১৯৭৫ সালের ২১ জুনটা ছিল আরো ‘বড়’। না, সময়ের হিসেবে নয়, গুরুত্বের বিবেচনায়। সেদিন ছিল প্রথম ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল। আজকালকার মত বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা না থাকলেও মাঠে ঠিকই উত্তেজনা ছিল। তাঁর ওপর স্বয়ং ক্লাইভ লয়েড ৮৫ বলে যখন ১০২ রানের ইনিংস খেলে ফেললেন তখন তো আর কথাই নেই। রোহান কাহ্নাই সাথে করেন ৫৫ রান।
৬০ ওভারের খেলা হত তখন। প্রথমে ব্যাট করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ আট উইকেট হারিয়ে করে ১০২ রান। জবাব দিতে নেমে নাকানিচুবানি খেতে হয় অস্ট্রেলিয়াকে। বিশেষ করে এক গাদা রান আউটে তাঁদের কপাল পুড়ে। ১০ টা উইকেটের মধ্যে পাঁচটাই রান আউটের শিকার।
এর মধ্যে তিনটারইনায়ক আবার স্যার ভিভ রিচার্ডস, যিনি সেদিন কভারে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিংয়ে কাঁপাচ্ছিলেন, যেন ব্যাট হাতে করা মোটে পাঁচ রানের ইনিংসের ব্যর্থতা পুষিয়ে দেওয়ার শপথ করেই নেমেছিলেন। ২৩৩ রানের মাথায় অস্ট্রেলিয়া নবম উইকেট হারায়।
তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়টা নিশ্চিতই। তবে, অজিদের পেস বোলিং জুটি ডেনিস লিলি ও জেফ থমসন শেষ চেষ্টাটা করেন ব্যাট হাতে। একাদশতম উইকেট জুটিতে তাঁরা যোগ করেন ৪১ রান। তবে, তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। ২৭৪ রানে অলআউট হও অস্ট্রেলিয়া। আট বল ও ১৭ রান দূরে থাকতেই তাঁদের লড়াই থামে। প্রথমবারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ক্যারিবিয়ান দলটি।
সেটা ছিল ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের স্বর্ণালী সময়। তখনই ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে। প্রথম দুই আসরে বাজিমাত করে বিশ্বসেরা মুকুট পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
দু’বারই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক ছিলেন কিংবদন্তি খেলোয়াড় ক্লাইভ লয়েড। ওই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিলো বিশ্বসেরা দল, তাদেরকে হারানোর ক্ষমতা কোন দলের ছিলো না। লয়েডও মনে করেন, ঠিক এমনই অপরাজেয় ছিল সেই দলটা।
১৯৭৫ সালের প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ১৭ রানে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনালে ৮৫ বল মোকাবেলায় ১২টি চার ও ২টি ছক্কায় ১০২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন অধিনায়ক লয়েড।
এরপর ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ৯২ রানে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা জিতে নেয় ক্যারিবীয়রা। এই ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভিভ রিচার্ডস। ১১টি চার ও ৩টি ছক্কায় ১৫৭ বলে অপরাজিত ১৩৮ রান করেন রিচার্ডস।
সত্তর-আশির দশকে বিশ্ব ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল অপ্রতিরোধ্য এক দল। বিশ্বের কোন দলই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লড়াইয়ের ছিটেফটাও দেখাতে পারতো না। ঐ সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করলেন লয়েড।
তিনি বলেন, ‘প্রথম বিশ্বকাপজয়ী আমার দলের সকল সদস্যদের কাছে সেটা স্মরণীয় দিন। জীবনের সেরা দিনগুলোর একটা এই দিনটি। গোটা টুর্নামেন্টে আমরা অপরাজিত ছিলাম। লর্ডসে জেতাটা ছিল অসাধারণ। পরপর দু’টো বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। আমাদের হাতে কাপ দেখতে যাঁরা এসেছিলেন, এটা ছিল তাঁদের জন্যও বড় পাওয়া।’
ওই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেমন ক্রিকেট খেলতো, তাতে কোন দলই লড়াই করতে পারতো না বলে জানান লয়েড, ‘আমরা ছিলাম বিশ্বসেরা একটি দল। আমাদের কেউ হারাতে পারতো না। বিশ্বের সব জায়গায় আমাদের সমীহ করা হত। ক্যারিবীয়ানে নানা ক্ষেত্রে, অনেক গ্রেটের জন্ম হয়েছে। আমরাও তার মধ্যে আছি। আমরা ছিলাম খেলায় সাফল্যের প্রতীক। আমাদের জয়গুলো ছিলো সমর্থকদের জন্য। শুধু আমাদের ক্রিকেটার বা দেশের জন্য নয়, আমাদের সাফল্য বিশ্বের নানা প্রাস্তের মানুষকে আনন্দ দিয়েছিলো।’
তবেই, সেই সবই এখন অতীত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট তাঁর সুদিন হারিয়েছে। যদিও, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁরা বড় শক্তিধর দেশ। ড্যারেন স্যামির নেতৃত্বে দু’বার ২০ ওভারের ক্রিকেটের শিরোপা জিতেছে তারা। যদিও, স্যামির দলের সাথে ক্লাইভ লয়েডদের তুলনা চলে না। ওই দলটা ক্রিকেটের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা দলগুলোর একটি!
১৯৭৫-এর ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল ১৭ রানে। দু:খজনক হল, ওই ফাইনালে একাই নো-বল থেকে ১৩ রান দিয়েছিলেন জেফ থমসন। ২১ রানের ইনিংস খেলে থমসনই সেদিন শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আরেকটা রান আউটের শিকার হয়ে তার ও অস্ট্রেলিয়ার চেষ্টা বৃথা যায়। ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপের কাছ থেকে ট্রফি পান ক্লাইভ লয়েড।
বছরের সবচেয়ে বড় দিন বলেই কি না, ম্যাচটির আকারও ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। সকাল সাড়ে দশটায় শুরু হওয়া ম্যাচ শেষ হয় রাত আটটা বেজে ৪৩ মিনিটে গিয়ে। দু’দল অতিরিক্ত খাত থেকে মোট ৩৫ রান দেয়!