ফুটবল বিশেষ বিশেষ সময়ে কবিতা। ছন্দ, প্রীতি, আরও অনেক কিছু যা সংজ্ঞায়িত করে একটা সৌন্দর্যকে। যেটা এই পৃথিবীতেই বানানো। মনুষ্যসৃষ্ট সৌন্দর্য। সাবজেক্টটাকে অনেকে হাতে ধরে সুন্দর করেছে, তাকে কবিতা লিখতে শিখিয়েছে। অথচ সুন্দরের পূজারী নন, এমন মানুষও কথা বলার অস্ত্র হিসেবে ফুটবলকে বেছে নিয়েছেন। প্রত্যেকটা জিনিসের ভাল-মন্দ দিক থাকেই। ফুটবলেরও আছে। ৬-৪-০ যেমন কোনও ফর্মেশন হতে পারে না।
৫-৫-০ও হতে পারে না। অথচ এরকম ফুটবলও হয়েছে। আবার তেমনি কিছু কিছু ফর্মেশন সৌন্দর্য-নির্ভর। এসব থাকবেই। কিন্তু যেটা করতে গিয়ে ঘাম ঝরে, তা হল ইট-কাঠ-পাথরকে দিয়ে বিচ্ছেদের কবিতা লেখানো। পাথরের নিজস্ব অনুভূতি নেই। সে কাজ জানে। তাতে সামান্যতম ঢিলেমি দেখলে নিজের স্ট্রাকচার বদলে ফেলতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। অথচ কবিতা লিখিয়েরা এটা করতে পারবে না সহজে। তারা অনুভূতিপ্রবণ, তারা কষ্ট পাবেন। আবেগপ্রবণতা সহজে কাটিয়ে ওঠার বস্তু নয়।
হোসে মোরিনহো বাস্তবে ঠিক এই রকম একটা লোক। পাথর, পাথরের পর পাথর দিয়ে সাজানো একটা মানুষ। নিজের চারপাশে একটা অন্ধকার জগত তৈরি করে তাতে বেঁচে থাকা একটা মানুষ। যার তারকা খেলোয়াড়ে সমস্যা হয়নি। বরং তারকা তার হাতে, থুড়ি মস্তিষ্কে তৈরি। যিনি কখনও ভাবেননি ফুটবলে একটা নির্দিষ্ট পন্থা আছে, পদ্ধতি আছে। সে পদ্ধতির বিশ্লেষণ আছে।
‘অমন পদ্ধতিতে লাভ কী যদি ট্রফিই না আসে?’ অকপট হোসে মরিনহো প্রশ্ন ছুঁড়েছেন প্রেস কনফারেন্সে বসে। যাদের কাছে ছুঁড়েছেন, খোঁজ করলে দেখা যাবে আধুনিক ফুটবলের ট্রান্সফর্মেশন নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভেবেছেন তাঁরাই। অথচ মরিনহো মানেন না। বার্সেলোনা পেপ গার্দিওলাকে ডেকে নিল, মোরিনহোকে ডাকল না। অভিমান এতটাই ছিল, রিয়ালে কোচ থাকাকালীন ক্যাসিয়াসকে ঝাড়তে পর্যন্ত দ্বিধা করেননি। দোষ কী ছিল? জাভিকে ফোন করা!
এ হেন মোরিনহো ইউরোপ জিততে নিজে ব্যর্থ হয়েছেন রিয়ালেই। তার মধ্যেও লিগে সাফল্য হয়তো এসেছে। মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হাতে ওঠেনি তাঁর। অথচ সেই লোকটাই পোর্তোর মতো টিমকে জিতিয়েছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। ইন্টার তো স্ট্রং টিম ছিল। এবং প্রত্যেকে আনডাউটেডলি সেই বছরের সেরা প্লেয়ার ছিল।
দিয়েগো মিলিতো ছিল, ক্যাম্বিয়াসো ছিল, সর্বোপরি স্নেইডার আর জানেত্তি ছিল। কিন্তু পোর্তো? ডেকো উঠছে তখন। বেন ম্যাকার্থি চূড়ান্ত ফর্ম ফিরে পেল কোন দাওয়াইতে কে জানে! ম্যাঞ্চেস্টার আটকে গেল, লিঁও আটকে গেল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেপোর্তিভো লা করুনা (যে টিমে তখন রাইট ব্যাকে খেলছেন আজকের বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি) সেমিতে উঠে আটকে গেল এই পোর্তোর কাছে।
শুধু প্লেয়ার বাই প্লেয়ার ডিফেন্স করিয়ে এবং ডানে-বাঁয়ে শিফট করিয়ে করিয়ে একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়ে দিল হোসে মোরিনহো। সেই হোসে মোরিনহো, যে পেপ গুয়ার্দিওলার আগমনে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির দুর্বার উত্থানের মধ্যেই প্রিমিয়ার লিগে দুম করে চেলসিকে লিগ জিতিয়ে দেন একদা।
যিনি ঐ ম্যনচেস্টার ইউনাইটেডকে টেনে নিয়ে লিগে রানার্স করান। যাকে দেখলে লোকে বলে আত্ম-অহংকারী। উন্নাসিক। যার মুখ ধারালো তলোয়ারের চেয়ে কম কিছু নয়। কেউ ট্রফি দিতে না পারলে যিনি বলেন, ‘উনি তো ব্যর্থতায় পিএইচডি করেছেন।’ আর নিজে কোনও টুর্নামেন্টে আটকে গেলে সটান ভেসে আসে, ‘আমার মতো ট্রফি আর ক’টা কোচের আছে?’
বিশ্লেষণের তাত্ত্বিক কচকচি বাদ থাকুক। থাকুক মরিনহো। যাকে ডুয়েলে দেখলে পেপ খেপে উঠবেন। যাকে সঙ্গে করে একদা ভাল কিছু করার আশা জেগেছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ড্রেসিংরুমে। ২০০৮-এর ইউসিএলের পর সেই প্রথম কোনও ইউরোপিয়ান ট্রফি জেতা তাদের। সেই টিমও কি খুব শক্তিশালী ছিল? ফর্ম হারানো আন্দ্রে হেরেরা ঐ একটা টুর্নামেন্ট অবিশ্বাস্য রকমের ভাল খেলেছিল।
ডিফেন্সে নিত্যদিন গালাগাল খাওয়া ক্রিস স্মলিং। বাঁয়ে হুয়ান মাতা। এই তো ছিল সংসার। রিয়ালে করিম বেনজেমা গোল করতে পারছে না তখন। যাবতীয় জয়ের মালা যা ছিল সব পৌঁছে যাচ্ছে রোনালদো, হিগুয়েনদের রুমে। ওজিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম্বার টেন তখন। কাকা মনমরা। এগুলোও তো মরিনহো।
টিমে একজন মরিনহো থাকার অর্থ মরিনহো সবার মধ্যে। কারোর মধ্যে বরফ, কারোর মধ্যে আগুন হয়ে থাকছেন। পদ্ধতিহীন, বিশ্লেষণহীন একটা স্বপ্নের পেছনে ক্রমাগত ছোটা, ছোটা… যেখানে হার বলে কিছু নেই। সেই একই ‘পার্ক দ্য বাস’-এর উপর ভিত্তি করে লোকটা রোমাকেও ইউরোপ জয়ের স্বাদ পাওয়ালো প্রথমবার।
হোক না থার্ড টায়ার, হোক না কনফারেন্স লিগ। আসলে মরিনহো হারতে ভয় পান। হার তাঁর কাছে ভয়ের, আতঙ্কের। অনেকটা ঐ ‘হেরে গেলে কী করব’ টাইপের। মানতে চাননি কখনও যে তিনিও হেরেছেন অন্যদের মতো। তিনিও একবার হলেও পরাজিত। ‘ডিফিট’ শব্দটা থেকে পালাতে চান মরিনহো। ওপরে দেখান কিছুই হয়নি। এফেক্ট করে, আফটার অল মরিনহো রক্তমাংসেরই তো একজন!
অথচ কখনও মনে হয় লোকটা একদিন কবিতা লিখবে। সেই মানুষটা মোরিনহোর অনেক ভেতরে আছে। হারের অন্ধকার বাঁচিয়ে চলা মানুষটা ভেতর থেকে চাইবে একদিন যে বিয়েলসা, পেপ, ওয়েঙ্গারের মতো আমিও লিখি নতুন কিছু। ফুটবলকে জাপটে ধরে বেঁচে থাকা, তাকে নিয়ে এত গল্প, এত ভাবনাচিন্তার আখর – এসবকে নিয়ে একদিন অন্য মরিনহো আসবে পৃথিবীর দরবারে। সেদিন ফুটবল নিজে থেকেই হাসবে। ভাববে, যাক! পাথরটা অবশেষে গলে পড়ল তবে।
সব পাথর কি মরিনহো হতে পারে? কে জানে!