সফল দ্রাবিড় সভ্যতা

ছোটবেলা থেকে যে লোকটার খেলা দেখে প্লাস্টিকের ব্যাট হাতে অনুকরণের চেষ্টা করেছি, এখন বারবার জানার চেষ্টা করেছি সেই জিনিসটা সম্পর্কে যা ১৬ বছর ধরে একজনকে তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে। পুরোনো সাক্ষাৎকার ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম একটি অসাধারণ লাইন তিনি বলছেন। ২০১১ সালে বিশ্বজয়ের পর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো দলে থাকতে না পারায় তিনি ঈর্ষান্বিত কিনা তিনি বলেন, ‘ঈর্ষা করে লাভ নেই। আমি নিজেকে একটাই কথা বলি যে রাহুল কাল সকাল নয়টায় নেট। ওটা তোমার কন্ট্রোলে - বাকি কিছু নয়।’

২০ জুন ১৯৯৬। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের সফরের দ্বিতীয় টেস্ট শুরু হতে চলেছে। এসেক্সের বিরুদ্ধে ৫১,অপরাজিত ৩৪, ডার্বিশায়ারের বিরুদ্ধে একটি ঝাঁ চকচকে ৬৪ রানের ইনিংস খেলার পরে বাংলা থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এর অভিষেক যখন নিশ্চিত তখন ভারতীয় দলে অন্যতম ভরসাযোগ্য সঞ্জয় মাঞ্জরেকার হয়ে পড়লেন চোটগ্রস্ত।

ম্যাচের দিন সকালে যখন তিনি ফিটনেস টেস্টে ব্যর্থ হলেন তখন ঠিক টসের ১০ মিনিট আগে ম্যানেজার সন্দীপ পাতিল গেলেন এক ৫ফুট ১০ ইঞ্চির মারাঠি যুবকের কাছে। ২৩ বছর বয়সী ছেলেটা ইংল্যান্ড সফরের ট্যুর ম্যাচে ব্যর্থ হচ্ছিলো বেশ তবে সম্বল ছিলো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৬১.৭৯ গড়ে ৪২০২ রান। ব্যাট করতে যাওয়ার আগে এগিয়ে এলেন আগের টেস্টে অভিষেক করে লর্ডস টেস্টে পাঁচ উইকেট নেওয়া ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। সৌজন্য বিনিময়ের পরে ভারতের ২০৭তম টেস্ট ক্রিকেটার বললেন, ‘তুমি বোলারদের বোর্ডে নাম তুলেছো, আমি ব্যাটসম্যানদের বোর্ডে তুলবো।’

কথা রাখতে লেগেছিলো পনেরো বছর। অভিষেকে জ্যাক রাসেলের হাতে ক্যাচ দিয়ে মাত্র পাঁচ রানের জন্য যে চাঁদমারী হাতছাড়া হয়, ২০১১ সালে অ্যান্ডার্সন-ব্রড-ট্রেমলেটদের সামনে সেঞ্চুরির পরে তোলা মুষ্টিবদ্ধ হাত যেন সেই কথা রাখার আনন্দ জাহির করলো ভীষণ ভাবে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কাটিয়েছেন ১৬ বছর প্রায়। এই ১৬ বছরে ভারতের সবচেয়ে বড়ো টেস্ট ম্যাচ উইনারদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘অবিসংবাদি সেকেন্ড বয়’। সেকেন্ড বয় কেন? মাথার ওপরে ফার্স্ট বয় হিসেবে যে শচীন টেন্ডুলকার বসে আছেন। তথ্য বলে ভারতের জয়প্রাপ্ত ম্যাচে দ্রাবিড় ৬৫.৭৮ গড়ে করেছেন ৫১৩১ রান। বিদেশের মাটিতে জয়প্রাপ্ত ম্যাচে সেই ব্যাটিং গড় ছুঁয়েছে ৬৯.৪৮!

অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ গাঙ্গুলীর অধিনায়কত্বে ২১টি টেস্ট জেতে ভারত সেখানে তার রান সংখ্যা ৩২ ইনিংসে ২৫৭৩ এবং গড় ১০২.৯১! এর মধ্যে রয়েছে ফলোঅন করে করা ইডেনের ঐতিহাসিক ১৮০, অ্যাডিলেডের ২৩৩। বলে রাখা ভালো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জেতা টেস্ট ম্যাচে রাহুল দ্রাবিড়ের গড় ১৩৩.৬৭, ইংল্যান্ডে সেটাই ৯৮, পাকিস্তানে জয়প্রাপ্ত টেস্টে করেছিলেন ২৭০, নিউজিল্যান্ডে ২০০৯ সালে জেতা টেস্টে রাহুল করেন ৬৬।

একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকায় তার দুরুহ ব্যাটিং বাদ দিলে বাকি সবজায়গায় সংখ্যা ভীষণরকম উজ্জ্বল। এতো কিছুর পরেও যদি ম্যাচ উইনারদের তালিকায় শীর্ষস্থান না দিই তবে কি সেই তালিকার অপমান নয়?

ছোটবেলা থেকে যে লোকটার খেলা দেখে প্লাস্টিকের ব্যাট হাতে অনুকরণের চেষ্টা করেছি, এখন বারবার জানার চেষ্টা করেছি সেই জিনিসটা সম্পর্কে যা ১৬ বছর ধরে একজনকে তার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করে। পুরোনো সাক্ষাৎকার ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলাম একটি অসাধারণ লাইন তিনি বলছেন। ২০১১ সালে বিশ্বজয়ের পর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো দলে থাকতে না পারায় তিনি ঈর্ষান্বিত কিনা তিনি বলেন, ‘ঈর্ষা করে লাভ নেই। আমি নিজেকে একটাই কথা বলি যে রাহুল কাল সকাল নয়টায় নেট। ওটা তোমার কন্ট্রোলে- বাকি কিছু নয়।’

আজ রেকর্ড বই দেখতে বসে ভাবি এতসব স্থাপত্য তৈরী করতে একজন শিল্পীর যে মানসিকতা লাগে, তার যা একাত্মতা লাগে তা নিশ্চয়ই সকালের নেট সেশন থেকেই শুরু হয় এবং সেই একাত্মতায় ছেদ পড়েনা একদিনের জন্যও।
এতসত্ত্বেও দ্রাবিড় একজন দ্বিতীয় সারির মানুষ। খেলোয়াড় জীবনে তার প্রায় সব কৃতিত্বই লাইমলাইট হারিয়েছে কারোর না কারোর কাছে।

অভিষেক টেস্টের ৯৫ সৌরভের বীরত্বে ঢেকে যাওয়া হোক কি জ্বরের ওষুধ খেয়ে করা ১৮০ ঢাকা পরা লক্ষণ গরিমায়- হয়ে গেছেন দ্বিতীয়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ বিখ্যাত হয়ে থাকে শচীন টেন্ডুলকারের বাবা মারা যাওয়া উত্তর দারুন সেঞ্চুরি ও সৌরভ গাঙ্গুলীর ১৮৩ এর জন্য- ওই টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি খেলে ৪৬১ রান করেন রাহুল দ্রাবিড় যা ছিলো সর্বোচ্চ। সেই কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও অদ্ভূতভাবে ‘সেকেন্ড বয়’।

ইডেন গার্ডেন্সকে বলা হয় তা তিন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের – মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, ভিভিএস লক্ষণ এবং রোহিত শর্মার। এই মাঠেই ৬৮ ব্যাটিং গড়ে টেস্ট ক্রিকেটে ৯৬২ রান করেছেন রাহুল, রয়েছে চারটি শতক। অথচ এই মাঠ ফিরিয়ে দিয়েছে বিশ্রী ঘৃণা।

অবশ্য তার মতো লোকেরা হতে পারেন বিস্মিত তবে বাইরের কোনোরকম প্রভাব যে নিজের মধ্যে আসতে দিলে চলবেনা তা জানেন বিলক্ষণ। তিনি জানেন যে তার কাজটা থাকবে তার হাতে, বাকিসব তো কন্ট্রোলেই নেই। ক্রিকেট জীবনে কাজটা ছিলো নেটপ্র্যাক্টিস, এখন ক্রিকেটোত্তর জীবনে হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যবেক্ষণ।  সেখানেও হতে হবে সফল এবং গড়তে হবে দ্রাবিড় সভ্যতার নতুন ইমারত। একটাই তো জীবন কালিদা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...