তোমায় আমায় মিলে, এমনি বহে ধারা

শৈশব আর কৈশোরের মাঝে উদ্দাম প্রলোভনের মতো তখন মাহি ছিলেন। এখন যৌবনের অলস বয়ে চলায় মাহি আছেন। তবে বদলে গেছে উপস্থিতির ডায়মেনশন। ঋষাভ পান্ত আর মাহি যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসছেন মনে হচ্ছে যেন দুটো সময়ের ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ছে  এ হৃদয় দফতরে। স্মার্টফোনের ভিড়, সেকেন্ডে সেকেন্ডে ক্রিকবাজ স্কোর, স্মার্ট টিভি, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, টুইটারের ঝকঝকে পৃথিবীতে ঋষভ পান্ত এসেছেন সেই সেনসেশন হয়ে।

এক দিকের হলুদ জার্সি পরা মানুষটি যখন বাইশগজে প্রথম পা রাখেন তখন আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে সদ্য একটু একটু করে ঢুকছে কালার টিভি। কম্পিউটার তখনও আসেনি ঘরে ঘরে। টেলিভিশন চ্যানেল টেন স্পোর্টসের টপ টেন বোলার, টপ ব্যাটসম্যানদের নাম দেখতে অপেক্ষা করে থাকছে হাজারে হাজারে চোখ। খবরের কাগজে তারা দেখে নিচ্ছে ম্যাচটাইম। তখন কোথায় ইন্টারনেট? কোথায়ই বা স্মার্ট টিভি? ওত কিছু ভাবার সুযোগই ছিল না আমাদের।

স্মার্টফোনের মাদকতার  বদলে তখন দেশের অলিতেগলিতে ছেলেরা বিকেল হলেই নেমে পড়ছে ক্রিকেটের মহড়ায়। নোকিয়া কোম্পানি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটের বদলে নিয়ে আসছে রঙিন মোবাইল ফোন। পেপসি কোম্পানি তাদের সফট ড্রিংকের বোতলে ছাপছে ক্রিকেট সেনসেশনদের ছবি। স্রেফ সেই ছবি জোগারের নেশায় বেড়ে যাচ্ছে কোল্ড ড্রিংক্সের বিক্রি।

রথের মেলায় বিক্রি হচ্ছে দেওয়াল জোড়া পোস্টার। কৈশোরের উদ্দামতা তখন দেখছে লম্বা চুলের এক স্টাইল সেনসেশনকে, বুটকাট জিন্সের ভিড় বাড়ছে শহরে, স্লিভলেস গেঞ্জির ভেতর তখন সৌরভ-শচীন-দ্রাবিড় লেগ্যাসি ছেড়ে বোহেমিয়ান হতে চাইছে একটা প্রজন্ম।

মাহি মানে মহেন্দ্র সিং ধোনি এসেছিলেন। দেখেছিলেন। জয় করেছিলেন। কিন্তু পথটা সুগম ছিল না। ভারতীয় ক্রিকেটের ২০০৭ সালের ভরাডুবির পর একটা কাট আউট জ্বলছিল দাউ দাউ করে। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার ঠিক পরের দিন। তাতে লেখা ছিল – ‘A style sensation can’t be a cricket sensation in our country.’

মাহি এই জ্বলন্ত আগুনের কালোকালো অক্ষরে নিজেকে পুড়িয়েছেন। বিতর্কের অগ্নিকুণ্ডে নিজের সমস্ত উদ্দামতাকে আহুতি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন এক শান্ত মৈনাকের মতো। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আপামর বিশ্ব দেখল এক আশ্চর্য এনিগমা, আর ভারত পেয়ে গেল তাঁদের ক্যাপ্টেন কুলকে। লম্বা চুলের স্টাইল আইকন মাহি থেকে ক্যাপ্টেন কুল হবার এই আশ্চর্য যাত্রাপথটাই ভারতীয় ক্রিকেটের রেনেসাঁ কিনা এ নিয়ে বিতর্ক থাকবে।

শৈশব আর কৈশোরের মাঝে উদ্দাম প্রলোভনের মতো তখন মাহি ছিলেন। এখন যৌবনের অলস বয়ে চলায় মাহি আছেন। তবে বদলে গেছে উপস্থিতির ডায়মেনশন। ঋষাভ পান্ত আর মাহি যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসছেন মনে হচ্ছে যেন দুটো সময়ের ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ছে  এ হৃদয় দফতরে। স্মার্টফোনের ভিড়, সেকেন্ডে সেকেন্ডে ক্রিকবাজ স্কোর, স্মার্ট টিভি, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ, টুইটারের ঝকঝকে পৃথিবীতে ঋষভ পান্ত এসেছেন সেই সেনসেশন হয়ে।

যেন একটা প্রজন্মের পাতা উল্টে দিচ্ছেন একাই, যেমনটা মাহি করেছিলেন আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে। মাহি এখানে দর্শকমাত্র। নিজের উত্তরসূরীর হাতে নিশ্চিন্তে মুড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের রাজপাট। এই নিখাদ বহমানতাকে দুহাতে আগলেছে সময়। সেখানে অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মহাকাল।

ক্রিকেট এবং সমাজের একটা সূক্ষ্ম যোগসূত্রকে মাহি অনুভব করেছিলেন, সেই অনুভবই মৌনতার ভেতর লিখেছিল নৈশব্দের জটিল ক্যালকুলাস। ঝকঝকে তরুণের কাছে সে পুঁথি বিলিয়ে দেবেন মাহি৷ প্রজন্মের ধুলো লেগে সে থেকে যাবে ভারতীয় ক্রিকেটের সোনালি দেরাজে। এক প্রজন্মের পিঠে হাত রাখবে আরেক প্রজন্ম –

তোমার মনে ভয়, আমার ভয় হারা

তোমার হল শুরু, আমার হল সারা…

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...