এই প্রশ্নটা অনেকদিন ধরেই উঠছিলো।
কার্যত ওয়েস্ট ইন্ডিজ গত কয়েক বছর ধরে এই প্রশ্নকে বুকে নিয়েই পথ চলছে। এই ফ্রাঞ্চাইজি বনাম আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের দ্বন্ধে ক্যারিবিয়রা গত কয়েক বছরে কখনোই তাদের সেরা খেলোয়াড়দের ওয়েস্ট ইন্ডিজের পতাকাতলে পায়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ার অনেক খেলোয়াড়ও আগাম অবসর নেওয়ার মত কাজ করেছেন। ফলে বলা চলে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া পুরো ক্রিকেট দুনিয়াকে এখন এই প্রশ্ন সামলাতে হচ্ছে।
ভারতের এই সমস্যা নেই। কারণ, তাদের দশেই বসে সবচেয়ে বড় টাকার টুর্নামেন্ট-আইপিএল। সে সময় ভারতের খেলা থাকে না। আর অন্য কোনো লিগে খেলা ভারতীয়দের জন্য নিষিদ্ধ। ফলে তাদের এই ডিলেমা নেই। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সমাধাণটা সহজ। তারা মূলত পিএসএল খেলে। ফলে তাদেরও এই দ্বন্ধে পড়তে হয় না। আর বাংলাদেশের এই দ্বন্ধ থেকে দূরে থাকার কারণ, আমাদের হাতে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ঝড় তোলার মত ক্রিকেটারই কম।
ছিলেন মূলত সাকিব আল হাসান। সেই সাকিবকে নিয়েই বাংলাদেশ এই প্রশ্নটা টের পেলো-ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট, নাকি জাতীয় দল?
এর আগে একবার মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে খানিকটা এমন ঘটনা ঘটেছিলো। মুস্তাফিজকে বিশ্রামে রাখার জন্য সেবার বোর্ড তাকে আইপিএলে যেতে দেয়নি। মুস্তাফিজকে সেবার বড় ধরণের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো; সে টাকা মুস্তাফিজ পেয়েছেন কি না, আমি জানি না।
কিন্তু এভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা জোর করে তো বেশীদিন আটকে রাখা সম্ভব না।
এই এবার বোর্ড কী করতে পারতো? সাকিবকে বলতে পারতো, ‘না, তোমাকে টেস্ট খেলতে হবে।’
সাকিব হয়তো একবারের জন্য এটা মেনে নিতেন। বারবার এমন হলে নিশ্চয়ই মানবেন না। একসময় তিনিও বলবেন, এনাফ ইজ এনাফ। তিনিও হয়তো বলে দেবেন, টেস্টই আর খেলবো না। এমনকি জাতীয় দলের হয়েই আর খেলতে না চাইলে সাকিবকে আটকানোর তো কোনো উপায় নেই।
তাহলে সমাধাণ কী? ক্রিকেট বিশ্ব কী এভাবেই চলতে থাকবে?
গেইল থেকে পোলার্ড, ডু প্লেসি থেকে সাকিব; এদের ছাড়াই কী আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট চলবে? নাকি এখানে কিছু করার আছে?
আছে। আমি মনে করি, আইসিসির এখানে অনেক বড় কিছু করার আছে।
আইসিসির আগে আমরা দেখি যে, আমাদের কিছু করণীয় আছে কি না। অনেকে বলছেন, যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মডেল অনুসরণ করে সাকিবসহ ফ্রাঞ্চাইজির আগ্রহ আছে এমন ক্রিকেটারদের ফ্রি ল্যান্স করে দেওয়া হোক। তারা সময় পেলে জাতীয় দলে খেলবেন। না পেলে তাদের ছাড়াই আমরা খেলবো।
এটা স্রেফ হাওয়াই একটা সমাধাণ।
দৃশ্যত মনে হচ্ছে, এতে আমাদের খুব ক্ষতি হবে না। কারণ, আইপিএলে যাচ্ছে তো সাকিব আর মুস্তাফিজ। ওদের ছাড়াও আমরা চলতে পারবো। কিন্তু আপনাকে কে নিশ্চয়তা দিলো যে, আগামী বছরই এই সংখ্যাটা বাড়বে না?
আমরা তরুন ক্রিকেটারদের প্রমোট করার কথা বলছি। সেই তরুনদের ভেতর থেকে তো বেরিয়ে আসবে আরও অনেক সাকিব-মুস্তাফিজ। ফলে আমরা কষ্ট করে করে একটা করে প্রজন্ম তৈরী করবো এবং তারা দু বছর পর ফ্রি ল্যান্স হয়ে যাবে। আমরা কখনোই আর সেটেল কোনো টিম তৈরী করতে পারবো না। এটা আমাদের একেবারেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শেকড়শূন্য একটা অবস্থায় নিয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, বিবেচনাটা কেবল আইপিএল না। এর বাইরে পিএসএল, সিপিএল, বিগ ব্যাশ আছে। এসব জায়গা থেকেও প্রস্তাব আসবে। আগামী বছরই মাঠে গড়াবে ইউএস মেজর লিগ। এটা হতে যাচ্ছে বিরাট টাকার খনি। এখানে টাকা ঢালছেন শাহরুখ খান, সত্য নাদেলা, মুকেশ আম্বানিরা। ফলে ইউএস লিগ অনেক ক্রিকেটারকে বাস্তুহীন করে ফেলবে।
তাহলে উপায়? এখান থেকে ক্রিকেটের মূল কাঠামোকে কিভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে?
এই কাজটা আইসিসিকে করতে হবে।
আইসিসিকে এখন ফিফার মত হয়ে উঠতে হবে। স্রেফ কিছু টুর্নামেন্ট আয়োজন করে দ্বায় সারা যাবে না; রেগুলেটরি বডি হয়ে উঠতে হবে। সোজা কথা, আইসিসিকে তার ক্রিকেটের চিরকালীন (ক্লাসিক) ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ক্রিকেটকে কেবল আর্ন্তজাতিক খেলার মোড়কে আটকে রাখলে আর খুব বেশীদিন এই সাম্রাজ্য চালানো যাবে বলে মনে হয় না।
আচ্ছা, একটু পরিষ্কার করে বলা যাক।
আগে ফিফার ভূমিকাটা দেখি আমরা। তারা কিভাবে ফুটবল চালায়? তারা কিন্তু বিশ্বকাপ, কনফেডারেশন্স কাপ ছাড়া নিজেরা কোনো আয়োজন করে না। বছর বছর আর্ন্তজাতিক আয়োজন বা দ্বিপাক্ষিক সফরের মাতবরি করাটা তাদের কাজ নয়। ফুটবলটাকে সারা বছর চালায় মূলত ক্লাবগুলো এবং ক্লাবের এই লিগগুলো দেখভাল করে আঞ্চলিক রেগুলেটরি বোর্ড (যেমন এএফসি বা উয়েফা)। ফিফা কী করে?
তারা রেগুলেটরি সংস্থাগুলোকে বলে দেয় যে, সারা বছর ক্লাব ফুটবল করো, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বছরে এই কয় দিনের উইন্ডো তোমাকে আর্ন্তজাতিক ফুটবলের জন্য রাখতে হবে। আর এটাই এখন আইসিসিকে করতে হবে।
সারা বছর ধরে প্রয়োজনহীন দ্বিপাক্ষিক সফর এবং প্রতি বছর একটা আইসিসি ইভেন্টের কোনো দরকার নেই। সারা বছর চলবে ফ্রাঞ্চাইজির খেলা। মূলত আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটের এখন যে মুখরোচক ব্যাপারটা, সেই জায়গাটা নিয়ে নেবে এই লিগগুলো। বছরে ধরা যাক, ৮ মাস একটার পর একটা এসব লিগ হতে থাকবে। লিগগুলোর রেগুলেটরি একটা বডি থাকবে। ক্রিকেটের ব্যাপ্তি যেহেতু ফুটবলের মতো বিশাল নয়; তাই এই বডির জায়গাটা আইসিসি নিজের হাতেই রাখতে পারে। তারাই সূচী করবে যে, কোন সময়ে কোন লিগ হবে। এই লিগগুলো থেকে আয়ের একটা অংশ আইসিসি খবরদারী সংস্থা হিসেবে পেতে পারে।
এবার বাকী যে চার মাস সময় থাকবে ক্যালেন্ডারে; সেখানে আইসিসি চালাবে আর্ন্তজাতিক ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। সবগুলো দল সীমিত ওভারের নানা টুর্নামেন্ট খেলবে এই সময়ে। কোনো দ্বিপাক্ষিক সীমিত ওভারের সফর আর হবে না।
একটু খেয়াল করেছেন যে, এই পুরো লেখায় আমি টেস্ট নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি।
কারণ, সেটা পুরো আলাদা একটা পরিকল্পনায় হবে। দ্বিপাক্ষিক সফরগুলো হবে কেবল টেস্ট কেন্দ্রিক। এবং সেটা সারা বছর চলতে থাকবে। এখন দেখেন, দৃশ্যটা কী দাড়ালো। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট যারা খেলতে চায়, তাদের টেস্ট দলে আর বিবেচনা করার সুযোগই থাকছে না। মানে, আপনাকে টেস্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলাদা একটা টিম করতে হবে। আর এটাই টেস্ট ক্রিকেটকে বাচিয়ে রাখবে। পরষ্পরের মাটিতে আপনি তখন ৩ থেকে ৫ টেস্টের সিরিজ খেলবেন। সাথে সেই পুরোনো যুগের মতো অনেক প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবেন। কারণ, এখনকার মতো সময়ের টানাটানি তাতে আর থাকছে না।
তাহলে পয়েন্ট দুটো:
* এখন যেমন ফ্রাঞ্চাজি ক্রিকেটের জন্য উইন্ডো থাকে। তখন আর্ন্তজাতিক সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্য উইন্ডো থাকবে। উল্টে যাবে ব্যাপারটা।
* টেস্ট প্লানিংকে সীমিত ওভার থেকে পুরো আলাদা করে ফেলতে হবে। টেস্ট খেলোয়াড়রা ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলবেন না।
পুনশ্চ:
লেখাটা এটুকুতে আটকে রাখতে পারলে সুখকর হতো। কিন্তু এর মধ্যে আরেকটা আলোচনা তৈরী হয়েছে।
ফ্রাঞ্চাইজি লিগের টানে জাতীয় দলে না খেলাটাকে অনেকে টাকার কাছে ‘দেশপ্রেমের পরাজয়’ হিসেবে দেখতে চাইছেন। প্রথম কথা হলো, জাতীয় দলে খেলা মানেই দেশপ্রেম দেখানো, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ক্রিকেট খেলাটাকে একটা পারফরমিং আর্ট হিসেবে দেখাই ভালো। খেলোয়াড়রা মূলত খেলেন, টাকা পান; এটাকে পেশা হিসেবে ভাবাই ভালো। দেশপ্রেম এর তুলনায় অনেক বড় ব্যাপার। কোনো করপোরেট চাকরি করাকে দেশপ্রেমের মত মহান কাজের সাথে তুলনা করাটা ঠিক না।
তবে এর মানে এই না যে, আমরা ক্রিকেটারদের দেশপ্রেম না থাকার কথা বলছি। তারাও আমার-আপনার মত বাংলাদেশের মানুষ বা অন্য কোনো দেশের মানুষ। জাতীয় সঙ্গীত বাজলে তাদেরও চোখে পানি আসে, জাতীয় পতাকা দেখলে তারাও দাড়িয়ে যান।
সেই দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেন যে, একটা আলাদা গুরুত্ব তো আছেই।
কিন্তু ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে গেলে সেই দেশপ্রেম নষ্ট হয় না। কারণ, আগে এটা ক্রিকেটারদের পেশা। সেই পেশায় যেখান থেকে বেশী ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা পাবেন, তারা সেখানেই যাবেন। আইসিসি বরং এই পাশাপাশি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট ও জাতীয় দলের খেলা রেখে খেলোয়াড়দের একটা অন্যায় পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে।
দরিদ্র মানুষের সামনের টাকার তোড়া ফেলে কখনো তার সততা পরীক্ষা করা যায় না। ওই পরীক্ষাটাই অন্যায়। ফলে কোনো ক্রিকেটার ফ্রাঞ্চাইজিকে বেছে নিলে তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না প্লিজ।
দেশপ্রেম বুকের মধ্যেই থাক। তাকে টাকার সঙ্গে, খেলার সঙ্গে না মেলাই।