শত বছর আগের কথা। নির্দিষ্ট করে বললে ১০২ বছর। অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় এক দলের সাথে বাউরাল দলের ম্যাচ। কিন্তু বাউরাল দলের অধিনায়ক জর্জ হোয়াটম্যান ম্যাচ শুরুর বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ তার দলের খেলোয়াড় সংখ্যা কোনো ভাবেই ১১ জন হচ্ছিল না। জর্জ হোয়াটম্যানের ভাতিজা আবার সে ম্যাচের স্কোরার। কী আর করার! কোনো উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়েই নিজের ভাতিজাকে মাঠে নামিয়ে দিলেন হোয়াটম্যান। স্কোরার হয়ে গেলেন বাউরাল দলের এগারো নম্বর ক্রিকেটার। তো সে ম্যাচে স্কোরার থেকে মাঠে খেলার সুযোগ কে পেয়েছিলেন জানেন?
– স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। ব্র্যাডম্যানের ক্রিকেট খেলার শুরুটা এমন নাটকীয়ভাবেই হয়েছিল ৷ এগারো বছর বয়সী ডন অবশ্য সে ম্যাচটিতে একেবারে খারাপ খেলেননি। প্রথম ইনিংসে ৩৭ রানে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৯ রানে ছিলেন নট আউট।
এরপর একদিন ব্র্যাডম্যানের বাবা ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে গেলেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া মধ্যকার সে মৌসুমে অ্যাশেজের শেষ টেস্ট ম্যাচ চলছিল তখন। মূলত এ ম্যাচের পরই ডনের উপর ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ জেঁকে বসে। কারণ এর আগে কখনোই ব্র্যাডম্যান এমন স্টেডিয়াম দেখেননি। স্টেডিয়ামে থাকা দর্শকদের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনায় ডন এমনভাবেই ডুবে গেলেন যে তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একদিন খেলার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে গেলেন এক মুহূর্তের জন্য। বাবাকে এক প্রকার সংকল্পবদ্ধ বলেই দিলেন, আমি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে একদিন খেলবোই।
তবে ডন ব্র্যাডম্যান সম্ভবত কৈশোরে নিজেও দ্বিধান্বিত ছিলেন নিজের ভাবনা সম্পর্কে। হঠাতই মাথা থেকে ক্রিকেটার হওয়ার ভূত উধাও। নতুন করে টেনিসের নেশায় মত্ত হলেন তিনি। টানা দুই বছর ব্যাট বল আর বাইশ গজের ধারের কাছেও ঘেঁষলেন না। সময় কাটিয়ে গেলেন টেনিস কোর্টে। কিন্তু নিয়তি যার ক্রিকেটে লেখা সেই ক্রিকেট কি আর তাকে দূরে রাখে। আবারও ক্রিকেটের টানে ফিরে আসলেন ডন।
এসেই নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকালেন! অস্ট্রেলিয়া দলেও ঢুকে পড়লেন বেশ তাড়াতাড়িই। তবে অভিষেক টেস্টে ১৮ আর ১ রান করা ডন পরের ম্যাচেই দল থেকে বাদ পড়লেন। তবে পুরো ক্যারিয়ারে দল থেকে ডন বাদ পড়েছেন ঐ একবারই। এরপরে যখনই বাইশ গজে এসেছেন তখনই ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে তার ব্যাটিং শৈলী। আলো ছড়ানো শুরু হয় তখন থেকেই। এরপর থেকে সে আলোর তীব্রতা কেবল বেড়েছেই, ছায়া পড়েনি কখনো। হেসেছে তাঁর ব্যাট আর হয়েছে নতুন রেকর্ড।
স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের গ্রেটনেস নতুন কী লেখার বাকি আছে? তাকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সে লেখায় যে বিশেষণের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হবে- তা অবশ্যম্ভাবী। ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ গড়, ২৯ সেঞ্চুরি, ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি! এর সাথে এক সিরিজে সর্বোচ্চ ৯৭৪ রানের রেকর্ডটা তাকে নিয়ে গেছে একদম ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ট্রিপল সেঞ্চুরি হয়েছে ৩১ টি । চারজন ব্যাটসম্যান দুটো করে ট্রিপল করায় ট্রিপল সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ২৩। ব্র্যাডম্যান সেই চারজনের একজন, যিনি কিনা দু’বার ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। তবে এর মাঝে ব্র্যাডম্যান একটু অনন্য। ব্র্যাডম্যানই টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি এক ইনিংসে ২৯৯ রান করে অপরাজিত ছিলেন।
ব্র্যাডম্যান টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ২৯ টি। যদি ইনিংস অনুপাতে সেঞ্চুরি হিসেব করা যায় অবিশ্বাস্য এক পরিসংখ্যান চোখের সামনে চলে আসবে। সেটা হলো, ব্র্যাডম্যান প্রতি ১.৭৯ ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। এমন অনুপাত আর কারও নেই ক্রিকেট বিশ্বে।
৫২ টেস্টে ৬৯৯৬ রান আর ৯৯.৯৪ রেকর্ডধারী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ১০০ টা টেস্ট খেললে কিংবা শচীনের মতো ২০০ টা টেস্ট খেললে কি এই একই গড়ে খেলে যেতে পারতেন? এমন প্রশ্ন আমার, আপনার, সবার মনে উদয় হতেই পারে। তিনি এই গড়ে খেলতে পারতেন কিনা সেটা ছাপিয়ে ডনের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক।
২৩৪ টা প্রথম শ্রেণি ম্যাচের ৩৩৮ ইনিংসে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান করেছেন ২৮০৬৭ রান। গড় ৯৫.১৪! ১৯২৮ থেকে ১৯৪৮ টানা ২০ বছর তিনি এমন ধারাবাহিকভাবেই খেলে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে স্যার ডনের টেস্ট ক্যারিয়ারের ৮ টি বছর নষ্ট না হলে তার ক্যারিয়ার গ্রাফটা তাহলে কোথায় যেত একবার ভেবে দেখুন।
টেস্ট ক্রিকেটে দ্রুততম দুই হাজার (২২ ইনিংস), তিন হাজার (৩৩ ইনিংস), চার হাজার (৪৮ ইনিংস), পাঁচ হাজার (৫৬ ইনিংস) এবং ছয় হাজার (৬৮ ইনিংস) রান করার রেকর্ড তাঁর। ডন তার জীবদ্দশায় এ রেকর্ডগুলো অক্ষত অবস্থাতেই দেখে গেছেন। এমনকি তার মৃত্যুর দুই দশক পেরিয়ে গেলেও রেকর্ডবুকে এখনো তার এ রেকর্ডগুলো সমুজ্জ্বল।
ব্র্যাডম্যানের সময়ে ওয়ানডে ছিল না। তাই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ডন কেমন করতেন তার নিরীক্ষা হয়নি। তবে একটা প্রদর্শনী ম্যাচে তার পারফরম্যান্স দেখলে আবার ভালোভাবেই আঁচ করা যায়, সীমিত ওভার ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান কেমন বিধ্বংসী হতে পারতেন।
নিজ দলের সতীর্থ ওয়েন্ডেল বিলের সাথে একবার ব্ল্যাকহিথ নামে এক জায়গায় গেলেন ব্র্যাডম্যান। উদ্দেশ্য সেখানকার নতুন বানানো পিচে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলা। তখন ওভার হতো ৮ বলে। সেই ম্যাচে মাত্র ১৮ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন ডন। আর তাতেই কত রান করেছিলেন জানেন? ৩ ওভারের মাঝেই সেঞ্চুরি করে শেষ পর্যন্ত থেমেছিলেন ২৫৬ রানে।! এই রান করতে তিনি বাউন্ডারি মেরেছিলেন ২৯টি, ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন ১৪টি! সময়টা কিন্তু আজ থেকে আরো আট দশক আগের, ১৯৩১ সালে!
স্যার ডনের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একমাত্র আক্ষেপ হয়তো ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ে থেমে যাওয়া। ৪ টি রান করলেই হতে পারতেন ১০০ গড়ওয়ালা ব্যাটসম্যান। কিন্তু এরিক হলিস সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ডনের ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শূন্য রানে ফিরিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম আক্ষেপের জন্ম দেন তিনি। নার্ভাস নাইন্টি গড়ের কাটায় পড়া ব্র্যাডম্যান জীবন ঘড়ির কাঁটাতেও কাটা পড়েছিলেন নার্ভাস নাইন্টিতেই (৯২ বছর বয়সে)। কিন্তু বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ার ডনকে পরিণত করেছিল একজন ‘স্যার’ ডন ব্র্যাডম্যান হিসেবে।
৮০ ইনিংসের সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ার ডন ব্র্যাডম্যানের। কিন্তু ডনদের আলোক ঝলকানি দেখাতে তো আর পুরো সিনেমা জুড়ে থাকা লাগে না। সিনেমার ডনরা তো তাও বেশিরভাগ সময় শেষ মুহূর্তে পরাজয় বরণ করে। কিন্তু ক্রিকেটের স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের অনন্য সব রেকর্ড তো তাকে অনেক আগেই অপরাজেয় বানিয়ে দিয়েছে। কারণ তিনি ‘দ্য ডন অব ক্রিকেট’।