দ্য ফ্লাইং শিখ

পরবর্তীতে এই দৌড়ই যে তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান হয়ে যাবে তা তিনি তখনও জানতেন না। দেশভাগের পর ভারতে চলে গেলেন তিনি, তিন বার সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর চতুর্থবারে সেপাই হিসেবে ঢুকতে পারলেন সেনাবাহিনীতে। ফ্লাইং শিখ হয়ে ওঠাটা শুরু হলো এখান থেকেই। অমানুষিক পরিশ্রম, অদম্য জেদ, দুরন্ত অধ্যবসায় তাকে জায়গা করে দিল ভারতের ইতিহাসের পাতায়।

রেসের শুরুতেই অনেকটা এগিয়ে গেলেন আবদুল খালিক। ২০০ মিটারের রেস। দৌড়াচ্ছেন আরও বেশ কয়েকজন, কিন্তু সবার চোখ স্থির হয়ে আছে নির্দিষ্ট একজনের উপরে। মানুষটির নাম মিলখা সিং।

এই রেসের আগে মিলখা সিং বনাম আবদুল খালিক দ্বৈরথ নিয়ে পত্রিকাতে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর, রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে অনেকবার। লাহোরের স্প্রিন্ট ট্র্যাকের চারদিকে দর্শকের সংখ্যা প্রায় ৭০০০, এর বাইরে রেডিওতে কান পেতে আছেন বহু শ্রোতা এই দ্বৈরথের ফলাফল জানার জন্য।

সময়টা ১৯৬০ সাল। জেনারেল আইয়ুব খানের আমন্ত্রণে ইন্দো-পাক সম্মেলনে যোগ দিল ভারত, অনুষ্ঠিত হলো পাকিস্তানের লাহোরে। সেই সম্মেলন উপলক্ষেই আয়োজন করা হলো এ রেসের।

আবদুল খালিক মূলত ১০০ মিটার স্প্রিন্টের রাজা। ১৯৫৪ সালে ম্যানিলাতে এশিয়ান গেমসের আসরে তিনি ১০০ মিটার পার করেছিলেন মাত্র ১০.৬ সেকেন্ডে, এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ সময়ে। তাঁর দৌড় দেখে প্রধান অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁকে উপাধি দেন, ‘দ্য ফ্লাইং বার্ড অফ এশিয়া।’

অন্যদিকে, মিলখা সিংও তখন তার ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে। ১৯৫৬’র মেলবোর্ন অলিম্পিক গেমস দু:স্বপ্নের মতো কেটেছিল তার, বাদ পড়েছিলেন ২০০ মিটারের হিটেই। ৪০০ মিটারের স্প্রিন্টে অংশ নিলেও হয়েছিলেন চতুর্থ।

এর ২ বছর পরে, কার্ডিফে হওয়া কমনওয়েলথ গেমসের ৪৪০ মিটারে স্বর্ণ জয় করেন তিনি, স্বাধীন ভারতের কোন অ্যাথলেটের প্রথম স্বর্ণ জয় ছিল তা। এর কিছুদিন পরে টোকিওতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার দুই ইভেন্টেই সোনা জেতেন আবার। এর মধ্যে ২০০ মিটারের সোনা জয় ছিল এই আবদুল খালিককে হারিয়েই।

শুরুতে ফিরি আবার। অনেকটা এগিয়ে গেছেন আবদুল খালিক, পাকিস্তানের এই স্প্রিন্টারই যে জিততে যাচ্ছেন সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গেছেন অনেকে।

কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে কোত্থেকে যেন উদয় হলেন মিলখা সিং, অন্য সবাইকে তো বটেই, আবদুল খালিককেও পার হয়ে গেলেন অবলীলায়। দেখে আরও জোরে দৌড়াতে চেষ্টা করলেন খালিক। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলো না। মিলখা সিং নামের মানুষটা দুরন্তগতিতে দৌড়াচ্ছেন, উড়ছেন বলাটা সবচেয়ে ভালো। পায়ে যেন এক জোড়া ডানা গজিয়েছে তাঁর!

অথচ এই রেসে অংশ নিতেই চাননি মিলখা। যে মাটিতে তিনি তার পরিবারকে হারিয়েছিলেন, সে মাটিতে ফিরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু তাকে রাজি করালেন জওহরলাল নেহেরু। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয়, নিজের বাড়িঘর ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাল বহু পরিবার।

মিলখার বাড়ি ছিল পাকিস্তানের পাঞ্জাবে। তার পরিবারের গল্পটাও এরকম হতে পারত। কিন্তু হলো না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারাল তার পরিবারের অনেকে, মারা যাওয়ার আগে মিলখাকে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বললেন তার বাবা।

পরবর্তীতে এই দৌড়ই যে তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান হয়ে যাবে তা তিনি তখনও জানতেন না। দেশভাগের পর ভারতে চলে গেলেন তিনি, তিন বার সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর চতুর্থবারে সেপাই হিসেবে ঢুকতে পারলেন সেনাবাহিনীতে। ফ্লাইং শিখ হয়ে ওঠাটা শুরু হলো এখান থেকেই। অমানুষিক পরিশ্রম, অদম্য জেদ, দুরন্ত অধ্যবসায় তাকে জায়গা করে দিল ভারতের ইতিহাসের পাতায়।

মিলখা সিং যখন ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করলেন, ফ্লাইং বার্ড অফ এশিয়া তখনও অনেকটা পিছনে। তিনি ফিনিশিং লাইন ছোঁয়ার সাথে সাথে করতালির বন্যা বয়ে গেল দর্শকসারিতে। তাতে শামিল হলেন আইয়ুব খানও। একটু আফসোসও হলো হয়তো তাঁর।

মিলখা সিঙের তো এই ভূখণ্ডের হয়েই খেলার কথা ছিল! মিলখা সিং দৌড়ান, মিলখা সিং দৌড়ে যান। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি পিছনে ফেলতে চান তার অতীতকে। কিন্তু আসলেই কি অতীতকে পিছনে ফেলা যায় কখনও?

রেস শেষ হলে আইয়ুব খান যখন মেডেল পরিয়ে দিচ্ছেন, তখন তিনি মিলখাকে বললেন, ‘আমি আমার জীবনে এরকম দৌড়াতে দেখিনি কাউকে। আজ থেকে আপনার নাম ফ্লাইং শিখ।’

লেখাটা শেষ করছি, মিলখা সিঙের করা একটা চমৎকার মোটিভেশনাল উক্তি দিয়ে, ‘হার্ডওয়ার্ক, উইলপাওয়ার অ্যান্ড ডেডিকেশন, এ ম্যান উইথ দিস অ্যাবিলিটি, দ্য স্কাই ইজ দ্য লিমিট।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...