রিয়াল মাদ্রিদ যদি হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তবে ‘বরুণা’ চরিত্রে থাকবেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে ১০৮টি নীলপদ্ম খুজে এনে কিংবা দুরন্ত ষাড়ের চোখে লাল কাপড় বেঁধেও সুনীল যেমন পাননি বরুনাকে, তেমনি নিজেদের ক্লাব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অফার করা সত্ত্বেও কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দলে ভেড়াতে পারেনি রিয়াল মাদ্রিদ। বরুনা কথা রাখেনি, লস ব্ল্যাঙ্কোসদের দেয়া এমবাপ্পেও রাখেননি নিজের কথা। বর্তমান ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেইতেই আগামী কয়েক বছর থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
কিলিয়ান এমবাপ্পের রোনালদো-প্রীতির কথা জানা আছে ফুটবল ভক্তদের সবারই। নিজের আইডলের পদচিহ্ন অনুসরণ করে এমবাপ্পে দেখেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদে খেলার স্বপ্ন। আর তাই পিএসজি’র চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব গত মৌসুম পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন রিয়ালে খেলার ইচ্ছে। অল হোয়াইট প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ সেবার রেকর্ড ১৮০ মিলিয়ন ইউরো পরিশোধ করতে রাজি ছিল এমবাপ্পে’র জন্য।
তবে পিএসজির ম্যানেজমেন্টের শক্ত অবস্থানের কারণে সেবার সফল হয়নি রিয়াল মাদ্রিদের পরিকল্পনা। অবশ্য সবার ধারনা ছিল হয়তো বর্তমান চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই ফ্রি ট্রান্সফারের মধ্য দিয়ে প্যারিস ছেড়ে স্প্যানিশ ক্লাবটিতে চলে আসবেন কিলিয়ান। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ছিল পিএসজি’র মালিকপক্ষ, নিজেদের সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে এভাবে ফ্রি-তে ক্লাব ছাড়তে রাজি ছিল না তাঁরা।
আর তাই নতুন চুক্তির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল কিলিয়ান এমবাপ্পের কাছে। অবিশ্বাস্য বেতন সহ চোখ কপালে তুলে দেয়ার মত সুযোগ সুবিধা ছিল সেসব চুক্তিতে। কিন্তু চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্তে অনঢ় ছিলেন ফ্রেঞ্চ সুপারস্টার। ফলে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বেতনের অংক, পাশাপাশি অন্যান সুবিধাও। শুধু তাই হয়, নিজ দেশের সরকারের কাছ থেকেও চুক্তি নবায়নের আহ্বান পেয়েছিলেন কিলিয়ান।
সবমিলিয়ে গত কয়েক মাস থেকে ফুটবল বিশ্বে রিয়াল মাদ্রিদ, এমবাপ্পে আর পিএসজি’র একটি ত্রি-মুখী স্নায়ুযুদ্ধ চলমান ছিল। কখনো নতুন প্রস্তাব নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির ফরাসি ক্লাব, কখনো খবরের শিরোনাম রিয়াল মাদ্রিদের অফার। সকালে যদি এমবাপ্পে’কে পাওয়ার দৌড়ে পিএসজি এগিয়ে থাকে তো বিকেলে রিয়ালকে এগিয়ে রাখতেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া অফিশিয়াল খবরের নাম করে গুজব ছড়িয়েছে বারবার।
শেষপর্যন্ত গত এক বছর থেকে চলতে থাকা এই মেগা সিরিয়ালের সমাপ্তি ঘটেছে। প্যারিস সেন্ট জার্মেই’এর সর্বশেষ প্রস্তাবে রাজি হয়ে চুক্তি নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। এই খুশিতে ইতোমধ্যে ছোট খাটো একটি ঘরোয়া পার্টি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্যারিস সেন্ট জার্মেই কতৃপক্ষ।
নতুন চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই বছরের জন্য পিএসজি’তে থাকছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। এছাড়া চুক্তিতে আরো একবছর বাড়ানোর অপশন থাকায় ২০২৫ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের ক্লাবেই তাকে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বেতন হিসেবে প্রতি বছরে ৬০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি পাবেন এমবাপ্পে, এছাড়া সাইনিং বোনাস হিসেবে রয়েছে ১২০ মিলিয়ন ইউরো। এমন অবিশ্বাস্য বেতন নির্ধারনে স্বাভাবিকভাবেই সর্ব্বোচ্চ বেতন প্রাপ্ত ফুটবলারের তালিকায় সবার উপরে উঠতে যাচ্ছেন এমবাপ্পে। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় কিংবা ব্যালন ডি’অর জেতার মত মাইলফলক অর্জন করতে পারলে এমবাপ্পের জন্য রয়েছে বিশাল অংকের পুরষ্কার।
২০১৭ সালে মোনাকো ছেড়ে যাওয়ার সময় এমবাপ্পে প্রথমবার রিয়াল মাদ্রিদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ঠিক পাঁচ বছর পর আগের মতোই পুনরায় রিয়ালকে হতাশ হয়েছে। অথচ কিলিয়ান এমবাপ্পে’কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আরেক উদীয়মান তারকা আর্লিং হাল্যান্ডকে হারাতে হয়েছে স্প্যানিশ ক্লাবটিকে।
গত সপ্তাহে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের সর্বশেষ চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে এমবাপ্পের এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সাইনিং বোনাস হিসাবে ১৩০ মিলিয়ন ইউরো প্রদান, ছবির স্বত্ত্বে বিশাল আধিপত্য এবং একটি বছরে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়নের বেশি বেতন ইত্যাদি সুবিধা ছিল সে চুক্তিতে।
অন্যদিকে ফরাসি জায়ান্টরা এমবাপ্পে যা কিছু চেয়েছে তার সবই দিয়েছে, যার মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থও রয়েছে পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মাঠের খেলার দিক। পিএসজি-তে এমবাপ্পে একজন প্রজেক্ট লিডার হিসেবে থাকতে পারবেন। এমনকি নতুন ক্রীড়া পরিচালক, পরবর্তী কোচ নির্বাচন এবং অন্য খেলোয়াড় ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চাইলে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন তিনি।
এমন লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পারেননি এই স্ট্রাইকার। তবে বিতর্ক থাকতে ঠিক কি কারনে তিনি রিয়াল মাদ্রিদে না এসে পুরোনো ক্লাবেই থাকছেন। কেউ ভাবতে পারে, হয়তো পিএসজি’র বড় অংকের টাকা প্রভাবিত করেছে এমবাপ্পেকে; কেউবা ভাবতে পারে দলের স্পোর্টস প্রজেক্টের কেন্দ্র হওয়ার লোভেই নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন এমবাপ্পে। এছাড়া কাতার এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি দুইজনেই মিলিতভাবে পিএসজিতে থাকতে অনুরোধ করেছিলেন তাকে, আর তাই এমবাপ্পের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাবের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
যাহোক রিয়াল মাদ্রিদ নতুন করে নিজেদের দল সাজিয়ে নিতে বেশ তৎপর। আগামী মৌসুমে পুননির্মিত সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে জাঁকজমকপূর্ণ স্কোয়াড নিয়েই পা রাখতে চায় তারা। এখন দেখার বিষয়, কিলিয়ান এমবাপ্পে’র ট্রান্সফার ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে আর কোন কোন ফুটবলারকে দলে ভেড়ায় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা।