আড়ালে তার সূর্য হাসে

ইংলিশ সমর্থকদের ‘ইট’স কামিং হোম’ চ্যান্টে যখন চার দিক সরব হয়ে উঠেছিল, বিপরীতে ইতালিয়ান সমর্থকেরা মেতে উঠেছিলেন ‘ইট’স কামিং টু রোম’ চ্যান্টে। ফাইনালের আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যকার এ বাকযুদ্ধ উপভোগের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল বটে! একদিকে জার্মানির মতো হট ফেভারিট দলকে বিদায় করে কোয়ার্টার-সেমির বাধা পেরিয়ে ফাইনালে আসা ইংল্যান্ড, অন্যদিকে টানা জয়ের ধারায় থাকা ইতালি- এমন দুই দলের মধ্যকার ফাইনালের উত্তাপ যে মাঠের গন্ডি পেরিয়ে মাঠের বাইরেও ছড়াবে- এতে আর আশ্চর্যের কী!

একে তো ইংলিশদের ঘরের মাঠে ফাইনাল, তার ওপর খেলার তিন মিনিটের মাথায় লুক শ এর গোল- ইংলিশরা হয়তো প্রথমবার ইউরো জয়ের আনন্দে মেতে ওঠার রসদ পেয়ে গিয়েছিল তাতে। কিন্তু এতে কি আর টানা ৩৩ ম্যাচে অপরাজিত থাকা আজ্জুরীদের দমিয়ে রাখা যায়! বনুচ্চির গোলে সমতা, পরে টাইব্রেকারে ডোনারুমার পরপর দুই সেভ- আজ্জুরিদের ইউরো জয় ঠেকাতে পারল না ইংলিশরা!

গতিশীল ফুটবল, পাসিং ফুটবল কিংবা প্রতি আক্রমণাত্মক ফুটবল- ইউরোর পুরো আসর জুড়ে ফুটবল শৈলীর সব ধরনের উপকরণের মিশেলে দর্শকদের মুগ্ধ করে গিয়েছে আজ্জুরীরা। বিশ্বাস করবার উপায় নেই- এ দলটাই বছর তিনেক আগে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের মূল পর্বে উত্তীর্ণ হতে পারেনি! শুধু ’১৮ বিশ্বকাপই নয়, ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে ধীরে ধীরে ‘ফেভারিট’ তকমাটা হারাতে থাকে আজ্জুরীরা।

প্রীতি ম্যাচগুলোতে কালেভদ্রে জয় পেলেও বিশ্ব আসরগুলোতে নিজেদের ফুটবল আভিজাত্যের প্রমাণ দিতে পারছিল না তাঁরা। ২০১০ বিশ্বকাপে তুলনামূলক সহজ গ্রুপে থেকেও গ্রুপ পর্বের গন্ডি পার হতে পারেনি তাঁরা। আর তার পরের বিশ্বকাপেও ঠিক একই দশা। ইউরোর আসরগুলোতেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না তাঁরা। ২০০৮ ও ২০১৬ সালের ইউরোর আসরে কোয়ার্টারেই থামে তাঁদের যাত্রা। এ সময়ে প্রাপ্তি বলতে ২০১২ এর ইউরোতে রানারআপ হওয়া ছাড়া আর বলার মতো কিছু ছিল না তাঁদের। এক সময় বিশ্ব ফুটবল শাসন করা একটি দলের এমন অবস্থা কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেননি কেউ!

এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল ২০১৮ বিশ্বকাপে মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারা। অনেকের মতো ইতালির সে সময়কার গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফনও চেয়েছিলেন এই বিশ্বকাপ খেলে ক্যারিয়ারের ইতি টানার। ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে নিজ দলের এমন হতশ্রী অবস্থা দেখে আশাহত হয়েছিলেন তিনি। সুইডেনের বিপক্ষে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার ম্যাচে হারের পর তাঁর কান্নাভেজা চোখে বলা কথাগুলোতে তা-ই ফুটে উঠছিল- ‘শুধু আমার জন্যই খারাপ লাগছে না, ইতালিয়ান ফুটবলের সকলের জন্যই খারাপ লাগছে।’

তবে এমন পরিস্থিতেও নিজ দলের একজন পরিপক্ক নেতার মতো দলের ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে গিয়েছিলেন তিনি – ‘সামনে হয়তো আমাদের ভালো সময় আসছে। খারাপ পরিস্থিতিতেও কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তার পথ আমরা সবসময়ই খুঁজে পাই।’

হ্যাঁ, সে পথ খুঁজে পেয়েছে আজ্জুরিরা। অন্তত গত তিন মৌসুমের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে তাঁদের পারফরম্যান্স সেই কথা-ই বলে। ২০১৮ সালে অক্টোবরের পর থেকে ইউরো কাপের আগ পর্যন্ত সময়ে টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত ছিল তাঁরা। আর সেই ধারা অব্যাহত থাকে ইউরো কাপেও। দীর্ঘ সময় ধরে বাজে সময় পার করা ইতালির হঠাৎ এমনভাবে ফিরে এসে ইউরো জয় মোটেও চাট্টিখানি কোনো ব্যাপার নয়। বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ার থেকে ছিটকে পড়ার পর দলের ভেতরে-বাইরে করা হয় আমূল পরিবর্তন। আর তার পর থেকেই সাফল্যের গ্রাফ উর্ধ্বমুখী হওয়া শুরু করে ইতালিয়ানদের।

বিশ্বকাপে ইতালির মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা হারানোর পর ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির পদ ছাড়েন কার্লো তেভেচ্চিও, আর তার জায়গায় আসেন গ্যাব্রিয়েল গ্রাভিনা। দলের এমন করুণ পরিস্থিতিতে কোচিং প্যানেলেও আনা হয় পরিবর্তন। দলের প্রধান কোচের পদে জিয়ান পিয়েরো ভেন্তুরার স্থলাভিষিক্ত হন ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলান ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের দল ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক কোচ রবার্তো মানচিনি। প্রধান কোচের পদ গ্রহণ করেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন তিনি।

আজ্জুরিদের রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলার পুরনো সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বল পাসিং ও পজেশনিংয়ের ওপর জোর দেন তিনি। পাশাপাশি দল নির্বাচনেও ভেন্তুরার চাইতে ভিন্ন পথ অনুসরণ করেন তিনি। দলে জ্যেষ্ঠ সদস্যদের চাইতে তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে থাকেন। তাঁর সেই আস্থার প্রতিদান ভালো ভাবেই দিতে থাকেন বারেলা- ইনসিনিয়েরা।

এ সময়ে তৃণমূল পর্যায়ের ফুটবলে বিশেষ নজর দেওয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করে ফুটবল ফেডারেশন। তৃণমূলে খেলে যাওয়া ফুটবলারদের সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুত করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে ফুটবল ফেডারেশন, যার ফলও আসে হাতে-নাতে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৭ ও অনূর্ধ্ব ১৯ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপে রানারআপ হয় তাঁরা। পাশাপাশি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপেও রানারআপ হয় তাঁরা। আর এভাবেই এক ঝাঁক তরুণকে বাজ্জিও- পিরলোদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তৈরি করতে থাকে তাঁরা।

আজ্জুরীদের সাম্প্রতিক সাফল্যই প্রমাণ করে দিচ্ছে এমন পদক্ষেপের কার্যকারিতা। দলের রক্ষণ, মধ্যমাঠ, আক্রমণ- তিন বিভাগেই এই তরুণেরা জানান দিচ্ছেন নিজেদের সামর্থ্যের। রক্ষণে বনুচ্চি-কিয়েলিনির মতো অভিজ্ঞদের যেমন যোগ্য সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছেন তোলোই- এমারসনেরা, তেমনি মধ্যমাঠ সামলানোর কাজে ভেরাত্তিরা পাশে পাচ্ছেন জর্গিনহো-বারেলা-লোকাতেল্লির মতো নবাগতদের। আর ইনসিনিয়ে- কিয়েসা- বেলোত্তিরা যে ইতালিয়ান আক্রমণভাগকে পৌঁছে দিচ্ছেন সেরাদের কাতারে, তা তো এখন চোখের সামনে স্পষ্ট!

নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইতালির চোখ এবার পরবর্তী বিশ্বকাপে। দুর্বার গতিতে ছুটতে থাকা ইতালিয়ানদের পরের বছর অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের টিকিট পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে বলে মনে হচ্ছে না। কোনো অঘটন না ঘটলে অন্যতম ফেভারিট হিসেবেই ’২২ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে আজ্জুরিরা। তবে কি পরের বিশ্বকাপ রোমেই যাচ্ছে? প্রশ্নটা না হয় ভবিষ্যতের জন্য তোলা-ই থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link