এ লোক দু’টো অন্য গ্রহের

তবু, তবু, একদিন টি-শার্ট আর কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে দুজনকেই, যারা আজ আর শুধু নিছক খেলোয়াড় নন, লড়াই করে ফিরে আসা আর বেঁচে থাকার সলভ করে দেওয়া টেস্ট পেপার, অনেকের কাছে।

১.

২৯ জানুয়ারি ২০১৭।

খাঁদের কিনার থেকে পড়ে যেতে যেতে উঠে এসেছেন তিনি একটু আগে।প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে ৬-৪, ৩-৬, ৬-১, ৩-৬, ৬-৩, পাঁচ সেটের লড়াইতে রাফায়েল নাদাল-কে হারিয়ে ২০১৭ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে উঠেছেন তিনি, ৫ বছর পরে ফিরে আসার নতুন মহাকাব্য রচনা করে।

এবার বিজয় মঞ্চ। তখনো ঘামে ভেজা শরীরটা টেনে সেখানে উঠে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অনেক অভিনন্দন জানাবার পরে শেষে দর্শকদের বললেন – ‘টেনিসে ড্র থাকলে রাফার সঙ্গে আজ ভাগ করে নিতাম।

জীবনের যে কোন ক্ষেত্রের যে কোন ছোট বড় লড়াই যিনি বা যারা একা লড়লেও মনে মনে অনেককে নিয়ে অনেকের জন্য লড়েন নি, তার বা তাদের পক্ষে এগুলো বোঝা মুশকিল। এগুলো করে দেখাতে আর এভাবে বলতে দম লাগে।

রজার ফেদেরার এরকমই।

২.

৩০ জানুয়ারি ২০২২।

খাঁদের কিনার থেকে পড়ে যেতে যেতে উঠে এসেছেন তিনি একটু আগে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে ২-৬, ৬-৭, ৬-৪, ৬-৪, ৭-৫, পাঁচ সেটের লড়াইতে ড্যানিল মেডভেদেভ-কে হারিয়ে ২০২২-এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে উঠেছেন তিনি, ফিরে আসার নতুন মহাকাব্য রচনা করে।

এবার বিজয় মঞ্চ। তখনো ঘামে ভেজা শরীরটা টেনে সেখানে উঠে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বললেন – ‘এই ট্রফিটা আজ আমি জিতলাম৷ এই ট্রফিটা খুব তাড়াতাড়ি বেশ কয়েকবার তুমিও জিতবে। জীবনের অন্যতম কঠিন ও সেরা ম্যাচটা আজ খেললাম আর সে ম্যাচে আমার বিরুদ্ধে তুমি ছিলে। তোমাকে আগামীর শুভেচ্ছা। আমি এই কষ্টটা জানি। দানি, তোমার জায়গায় আমি অনেক বার দাঁড়িয়েছিলাম। তাই ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার গুরুত্ব আমি জানি।’

৩ জুন ২০২২।

কোর্ট ছাড়ার সময়ে অবসৃত জেভেরেভ-এর পাশে দাঁড়িয়ে যেন অস্ফুটে বলে গেলেন, ‘পাশে আছি। একা হেঁটো না বন্ধু!’ এবং সেদিনই বললেন ‘গ্র্যান্ড স্ল্যামের গুণতিতে কিছু আসে যায়না। আমরা তিনজনই একই সারিতে আছি।’

কোন তিনজন? বলার জন্য পুরস্কার নেই।

৫ জুন ২০২২। আর কখনো কেউ যা ছোঁবেন কিনা সন্দেহ, সেই ২২ নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম ঢুকে গেছে কিটিতে, সাংবাদিক সম্মেলনে অক্লেশে বলে দিলেন, ‘I’m not injured; I’m a player living with injuries. I can’t keep going with my foot asleep.’

পায়ের জন্য ১৮ বছর বয়সে যাকে অবসরের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, ২২ নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম সদ্য ৩৬য়ে পৌঁছে, তিনিই তো বলতে পারেন এই কথাটা।

জীবনের যে কোন ক্ষেত্রের যে কোন ছোট বড় লড়াইতে আপাতত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়ে যিনি বা যারা আবার সদর্পে ফিরে আসেন নি, তার বা তাদের পক্ষে এগুলো বোঝা মুশকিল।এগুলো করে দেখাতে আর এভাবে বলতে দম লাগে। রাফায়েল নাদাল এরকমই।

৩.

টেনিস খেলাটাই জিতে যায় একথা শুনলে। ভুল। জীবনটাই জিতে যায় একথা শুনলে। আরো কিছুদিন বাঁচার ইচ্ছে বাড়িয়ে দেয় এ সব কথা। আরো কিছুদিন বেঁচে নেওয়া যায় তাহলে জীবন ভাগ করে নিয়ে!

পেশাদারী লড়াইর অস্ত্র মানেই কসাইখানার ধারালো রামদা নয়, মানবিকতার গোলাপের তোড়াও। কারো কারো জন্য।

৪.

সময়ের স্টেশনে থমকে দাঁড়িয়ে দু’জনেরই বয়সের ট্রেন। টেনিসের শরীরী অরণ্যদেব ছাড়া আপনাদের দুজনকেই আর কোন শিরোপায় মানাবেনা।

হয়ত একশো বছর পরেও লন টেনিস এবং তার দর্শক থাকবে।অবধারিত প্রযুক্তি বাড়বে খেলায় (হয়ত সুপার Racket জাতীয় কিছু)। এবং দর্শনেও (হয়ত পামটপে মোবাইল স্ক্রীন জাতীয় কিছু)। তবু একটা বিষয়ে আমি, আমরা আর এখনকার দর্শকরা এগিয়ে থাকব / থাকবেন, একশো বছর পরের দর্শকদের তুলনায়।

এই দুজনের খেলা দেখে ফেলেছি / ফেলেছেন বলে। বিজ্ঞান সাইডে, দুজনের গাইডে। ছোট্ট ফিসফিস, বয়সকে কুর্নিশ।

তবু, তবু, একদিন টি-শার্ট আর কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হবে দুজনকেই, যারা আজ আর শুধু নিছক খেলোয়াড় নন, লড়াই করে ফিরে আসা আর বেঁচে থাকার সলভ করে দেওয়া টেস্ট পেপার, অনেকের কাছে।

৫.

এ লোক দু’টো অন্য গ্রহের। আর হবে না এমন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...