আপনি যদি ২০১৫ থেকে ২০২০ এর মধ্যকার টোটাল ক্রিকেটটা লক্ষ্য করেন, তো দেখবেন আপনি কাউকেই টেস্ট স্পেশালিষ্ট বা টি- টোয়েন্টি স্পেশালিষ্ট বলতে পারবেন না। কারণ এই শেষ পেন্টার ক্রিকেটাররা কি সুন্দরভাবে সব ফরম্যাটে মানিয়ে নিতে পারে, তা দেখলে বেশ ভালই লাগে। শুধুমাত্র একটা ফরম্যাটে এদের সীমাবদ্ধতা জিইয়ে রাখলে সেটা আমার মতে ভুল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চেতেশ্বরকে অন্তত কুড়ি পঁচিশটা টানা ওয়ানডে খেলালে ভারতকে চার নম্বর জায়গাটার জন্য এত হাপিত্যেশ করতে হত না (২০১৫ এর পর চার নম্বর জায়গাটার জন্য কম এক্সপেরিমেন্ট তো হয়নি)। তবে কিছু ক্রিকেটার অবশ্যই এই মতের ব্যতিক্রম, যেমন রোহিত শর্মা ব্রিসবেন বা দ্য ওভালে টকটকে নতুন লাল বলটা কতটা সামলাতে পারতেন বা ডাউন দ্য অর্ডারেও ভিভিএসের টেলএন্ডারদের নিয়ে লড়বার জায়গাটায় কতটা নিজেকে স্থাপন করতে পারতেন সে বিষয়টা পরীক্ষিত নয়।
কিছু ক্রিকেটারকে বাইরে রেখে ইন টোটাল বলা যেতে পারে আজকাল একটা ফরম্যাটে সীমাবদ্ধ কাউকে করা যায় না। ঋদ্ধিমান সাহাকে যদি মুশতাক আলী ট্রফিতে দেখেন, আপনি দেখবেন কি সুন্দর ও মানিয়ে নিতে পারে। আমি জানি মুশতাক আলী আর আইপিএল এক জিনিস নয়, কিন্তু ব্যাটসম্যানের প্যাটার্ন দেখে বোঝা যায় সে সব ফরম্যাটে উপযুক্ত কিনা। ঋদ্ধি তেমনই একজন উপযুক্ত খেলোয়াড়। কিছুদিন ঋদ্ধির একটা স্লো ইনিংস নিয়ে বেশ ট্রল হয়। কিন্তু একটি ইনিংস দেখে সব কিছু বিচার করবার আগে আপনাকে আগে বুঝতে হবে সেই খেলোয়াড়ের খেলবার ধরণ কী রকম।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানে কিন্তু সব সময় কুড়ি বলে পঞ্চাশ নয়। টি -টোয়েন্টি ক্রিকেটটাও একটা সায়েন্স। এই ধরুন রাহুল দ্রাবিড়। রাহুল দ্রাবিড় টি-টোয়েন্টির উপযুক্ত কিনা সেটা ও রাজস্থান রয়্যালসের জার্সি গায়ে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আইপিএলে ওর প্যাটার্নটা মডিফায়েড ভার্সন ছিল, পরিবর্তিত ভার্সন নয় কিন্তু।
আমি একটু বুঝিয়ে বলি।
যে দ্রাবিড় টেস্টে ৩৩ বলে ২ বা ৩ করবে, সেই দ্রাবিড় কিন্তু আইপিএলে ২০ বলে ৫০ করবে না। কিন্তু, তাই বলে কি ও আইপিএল স্পেশালিষ্ট হতে পারবে না? – হ্যাঁ, পারবে। আইপিএলে দ্রাবিড় ৩০ বলে ৩৬-৪০ করতে পারবে, তারপর ৪০ বলে ৫৫ বা ৫৭, আরেকটু চিটিয়ে গেলে ৪৫ বলে ৭০ হতেও বাঁধা নেই। ব্যাস আল্টিমেটলি দ্রাবিড়ের পাশে ৪৫ বলে ৭০। ভাল রান।
কিন্তু, দ্রাবিড় এটা করে যাবে ওর নিজের প্যাটার্ন চেঞ্জ না করেই।এই রানটাকে যদি পার্ট বাই পার্ট ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে দেখা যেতে পারে – প্রথম ৭-৮ বলে দ্রাবিড় ১ কি ২ এর বেশী করবেই না, পরের ১০ বলে খুব বেশী হলেও ১৩ কি ১৪। কিন্তু পরের ১২/১৩ বলে চিটালো দ্রাবিড় ১৮-২০ করতে অসুবিধা নেই।দ্রাবিড়ের ইন বিটুইন উইকেট রানিং ভালোই।
আর এর পরের প্রতি ১০ বলে ১৪-১৫ ক্যালকুলেট করে করে দিলে ৪৫ বলে ৭০ করতে অসুবিধাই নেই। এটাই দ্রাবিড়ের প্যাটার্ন। টেস্টে ও যেটা ৩০ বল থেকে শুরু করতো সেটা এখানে শুরু করবে ১০ বা ১১ নম্বর বল থেকে। মডিফায়েড প্যাটার্ন, কিন্তু পুরো চেঞ্জড ভার্সন নয়।
রাহানের প্যাটার্নও এরকমই। তাহলে এটা প্রমাণিত একজন এলিগেন্ট প্লেয়ার নিজের প্যাটার্নেই সব ফরম্যাটে উপযুক্ত হতে পারে। এবার প্রথম ৭/৮ বলে এরা ভুলবশত আউট হলে এদের নামের পাশে লেখা থাকলো ৭ বলে ১ করে আউট বা ১১ বলে ৪ করে আউট। ব্যাস সোশ্যাল মিডিয়ায় চিৎকার। আবার পরের ম্যাচেই এরা এদের স্ট্র্যাটেজি বা প্রসেসটা ফলপ্রসূ করে দিলে, এদের নামে উল্টো পোস্ট বেরোবে। কিন্তু আপনি যাই করে নিননা কেনো, এদের প্যাটার্ন আর প্রসেসটা কিন্তু একই থাকবে।
প্রথম পাঁচ ম্যাচে ৭ বলে ৫/৬ করে রাহানে আউট হলেও ষষ্ঠ ম্যাচে রাহানে কখনও প্রথম থেকে পিটাবেনা(ব্যতিক্রম- যদিনা ক্যাপ্টেনের ফ্রি হিটিং নির্দেশ থাকে)কারণ এরা একটা প্রসেসে বিশ্বাসী কারণ এরা জানে এদের নিজ নিজ প্রসেস প্রথম পাঁচ ম্যাচে ইমপ্লিফায়েড না হলেও ষষ্ঠ ম্যাচে হবে,আর তারপর সেগুলি কন্টিনিউ করবার রসদ এদের আছে। আবার ধোনির প্যাটার্নটা একটু আলাদা।
আপনি ওকে যা ইচ্ছে তাই বলুন না কেনো,ও প্রথমে ঠুকঠুকই করবে, ম্যাচটাকে ডিপে নিয়ে যাবে শুধুমাত্র সিঙ্গলস আর ডাবলস নিয়ে, তারপর লাস্ট দু’ওভারে বোলারের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নেবে। এটা বিভেনের কাছ থেকে ধার নেওয়া প্রসেস বলতে পারেন। নাম কামানোর জন্য ও লাস্ট ওভার ওয়েট করেনা।ওর এই প্রসেস নেবার কারণ আছে। কারণটা হলো ও জানে ও টিমের লাস্ট ব্যাটসম্যান। ধরুন ২০ বলে ৩০ দরকার।
হ্যাঁ, এটা দু ওভারেই করে দেওয়া যায়। কিন্তু ও করবেনা,কারণ যদি বাইচান্স আউট হয়ে যায় তাহলে বাকী ৩০ রান মাথা ঠান্ডা রেখে করবার ব্যাটসম্যান নেই। কিন্তু যদি সিংগলসকে ডাবলস করে চার ছয় না মেরে ও এটাকে ১২ বলে ২০ তে আনতে পারে,তাহলে একটা চার মেরে আউট হলেও ১০ বলে ১৬ রানটা একজন টেলেন্ডারের পক্ষে অনেকটা কম টেনশনের। সঞ্জয় বাঙ্গার কিছুদিন আগেই বলেছিলেন ২০০৭ এর পর ধোনি নিজের প্যাডে ৪ আর ৬ এর পাশে ক্রস আর ১/২ এর পাশে টিক চিহ্ন লিখে অনুশীলনে নামতো,যাতে ও ভুলেও ৪/৬ এর দিকে মন না দেয়।
তাই ২০০৭ এর পর ওর খেলার ধরন বদলেছে,যেটা আজও কন্টিনিউইং আর এতেই ও সাফল্য পেয়েছে তাতেই এতেই ও স্বাছন্দ্যবোধ করে আর এটাই ওর শক্তি। আমি যখন শুনি কিছুজন বলছেন সেই যখন শেষ তিন ওভারেই ধোনি পিটিয়ে নাম কামায়,তো মাঝের তিন ওভারে পেটায় না কেনো।প্রশ্নগুলো বেশ বোকাবোকা লাগে। কোনো বিখ্যাত খেলোয়াড় তার প্যাটার্ন চেঞ্জ করেনা। কারণ প্যাটার্নটাই তার নিজস্ব কমফোর্টেবেল প্রসেস আর এতেই সে সাফল্য পাবে।
আবার ঋদ্ধি টেস্টে অনেক পরে নামে, এমনকি অশিনের পরেও নামানো হয় ওকে,তাই ওর স্ট্রাইক সম্বন্ধে আপনারা ধারণা পান না, কিন্তু আপিএলে যতবার ও ওপেনিং করেছে, ততবার স্ট্রাইকের ভরসা দিয়েছে।আবার ঋদ্ধির ব্যাট ধরবার গ্রিপটা যদি লক্ষ্য করেন তো দেখবেন ওর শক্তিশালী হাতটা বটম হ্যান্ড পজিশনে,তার মানে ও হার্ড হিটিং নয়। কিন্তু ওর স্ট্রাইকটা অনেকটা ফ্রি ফ্লোয়িং।
যেটা সবসময় ৫০ বা ১০০ না করলেও, আপনাকে একটা ভালো স্টার্ট দেবে। আর সেটাও প্যাটার্ন আনচেঞ্জড রেখেই। আরবের পিচে দু একটা স্লো ইনিংস না হয় বাদই দিলাম। আজকাল তাই কেউই একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে সীমাবদ্ধ নয়। এলিগেন্ট ক্রিকেটাররা নিজের প্যাটার্ন আনচেঞ্জড রেখেই, প্রতি ফরম্যাটে সাফল্য পেতে পারে।