প্রাপ্তির সিরিজে অপ্রাপ্তি খুঁজি

  • এক

৪২ তম ওভারের পঞ্চম বল। মুস্তাফিজুর রহমান বল করতে দৌড়ে আসছেন। ডেলিভারি এন্ডে এসে বল ছোঁড়ার আগেই স্ট্রাইকে থাকা নিরোশান ডিকভেলাকে দেখা গেল অফ স্ট্যাম্পের দিকে সরে এসে স্কুপ খেলার জন্যে একেবারে তৈরি। ডিকভেলার লেগ স্ট্যাম্প তখন একেবারে ফাঁকা। মুস্তাফিজুর রহমান কি করলেন? অফ স্ট্যাম্পে সরে আসা ডিকভেলার জন্যে ডেলিভারিটাও করলেন অফ স্ট্যাম্প বরাবর। ডিকভেলা অবশ্য ঠিক করে রাখা শটটা খেলতে পারলেন না, কিন্তু মুস্তাফিজও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারলেন না।

মুস্তাফিজ এই সিরিজে ভাল বল করেছেন। আগে যেটা হত, ডেলিভারির বেশিরভাগ থাকত তাঁর স্লোয়ারে পূর্ণ। এই সিরিজে তা হয়নি। মোটামুটি অর্ধেক বা অর্ধেকের নিচে তিনি স্লোয়ার করেছেন। সিরিজে মুস্তাফিজের বোলিংয়ে বৈচিত্র্যও ছিল। কিন্তু এই বিচিত্রতার প্রয়োগ আরো দারুণ হতে পারে যদি তিনি ব্যাটসম্যানের মুভমেন্ট বুঝে বল করতে পারেন। অবশ্য ‘ব্যাটসম্যানের মুভমেন্ট বুঝে বল করা’ ব্যাপারটা শুধু মুস্তাফিজের জন্যে না, বাংলাদেশের বাকি সব বোলারের জন্যেও প্রযোজ্য। সাকিব আল হাসান ছাড়া আর কেউ এই মুভমেন্ট বুঝতে পারার ব্যাপারটা পারেন বলে মনে হয়না।

  • দুই

কন্ডিশন মেঘলা, মাঠে বাতাসও হচ্ছে বেশ। এমন সময় আপনি নতুন বল কার হাতে তুলে দেবেন? বাতাসের গতিকে কাজে লাগাতে পারে, কিংবা বলে গতি আছে এমন কাউকেই নিশ্চয়ই? কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল কি করলেন? তিনি বল তুলে দিলেন শরিফুল আর মিরাজের হাতে! শরিফুলের হাতে নতুন বল দেওয়ার যুক্তি আনাচে কানাচে ঘুরে যদিও বা একটু দেওয়া যায়, মিরাজকে দিয়ে এমন কন্ডিশনে নতুন বল ওপেন করানোর কোন যুক্তি কি থাকতে পারে?

আর তাছাড়াও দল থেকে মিরাজের ওপর যে রান আটকানোর দায়িত্ব বর্তানো হয়, সেই দায়িত্ব সামলানোর জন্যেও কি ওপেনিং ওভার ঠিকঠাক সময়? পাওয়ারপ্লেতে একজন অধিনায়ক হিসেবে আপনি কি চাইবেন? প্রতিপক্ষের ওপেনিং পেয়ার যাতে দাঁড়াতে না পারে, বড় পার্টনারশিপ করতে না পারে এমন কিছু নিশ্চয়ই? তো তার জন্যে দলের চাই উইকেট। সেই উইকেট নেওয়ার জন্যে এমন কাউকে বোলিং ওপেন করতে পাঠানো কতটুকু ঠিক দলে যার রোল মূলত রান আটকানো!

অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে তামিমের খামখেয়ালি অবশ্য এতটুকুতে আটকে থাকেনি। তিনি মাঠে আরো বেশ কিছু মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যেমন-

বারবার রান দেওয়ার পরও তিনি মোসাদ্দেককে বলে আনছিলেন। অথচ মোসাদ্দেকের চাইতে বোলিংয়ে আফিফ বেশি ‘অ্যাক্টিভ’ বোলার। ‘অ্যাক্টিভ’ বোলার বাদ রেখে ‘ব্যাটসম্যান কাম বোলার’ আনার কোন যুক্তি কি থাকতে পারে? অবশ্য ঐ সময়ে বারবার অফ স্পিনার আনারও কোন যুক্তি থাকতে পারেনা। কিন্তু বাংলাদেশি অধিনায়ক সেটাই বারবার করেছেন। এভাবে মুখস্থ অধিনায়কত্ব করে আসলে ‘অধিনায়ক’ হওয়া যায়, কিন্তু ‘বড় অধিনায়ক’ হওয়া যায় না। অবশ্য তামিম সেটা চান কিনা সেটাই বা কে জানে?

এই যেমন সাকিব আল হাসানকে তিনি বোলিংয়ে নিয়ে আসলেন ২০ ওভার শেষে, যখন কিনা ক্রিজে ব্যাটসম্যান সেট হয়ে গেছে। মাঝের ওভারে বোলিং শুরু করার মত বোলার তো সাকিব আল হাসান নন। আজীবন তাকে পাওয়ার প্লের আশেপাশে কাজে লাগানো হয়েছে, তিনি আমাদের উইকেট এনে দিয়েছেন। সাফল্যে ভাসিয়েছেন। আর সেটাই তো হওয়া উচিত। মাঝের ওভারগুলোতে বড় দলগুলো বল করতে আনে রান আটকানো বোলারদের। কখনও কখনও পার্টটাইমাদেরও এখানে দেখা যায়। দলের মূল বোলাররা বল করেন পাওয়ারপ্লেতে কিংবা স্লগ ওভারে। কিন্তু তামিম করেছেন উল্টো! অদ্ভুত!

  • তিন

বাংলাদেশের ওপেনিং পেয়ার আর ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে বড় রকমের একটা ধোয়াশা রয়েই গেল। হুট করে নাঈম শেখকে ধরে এনে ‘উঠ ছেড়ি তোর বিয়ে’র মত মাঠে নামিয়ে দেওয়ার যুক্তি টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে আছে কিনা আমি জানিনা। তবে যুক্তি যদি ধর‍তেই হয় সেক্ষেত্রে একটা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করা যাক।

লিটন দাস যে আজ দল থেকে বাদ পড়েছেন এটার পেছনে খুব সম্ভবত শুধুমাত্র এই সিরিজের অবদান নেই, আছে এর পূর্ববর্তী সিরিজের অবদানও। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড কিংবা শ্রীলঙ্কা – লিটনকে টানা খেলিয়েও কোন সাফল্য পাচ্ছেনা দল। সেক্ষেত্রে লিটনকে এ ম্যাচে বাদ দেওয়ার অর্থ পরিকল্পনা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া। ব্যাপারখানা এমন ‘অনেক হয়েছে বাপু আর না’। কিন্তু এর বদলে যদি লিটনকে আবার সামনের কোন ওয়ানডে সিরিজে দেখা যায়, তাহলে আজকে লিটনের দলে বাদ পড়াটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। যদি তাকে পরে নিতেই হয় তাহলে এ ম্যাচে বাদ কেন? আবার বাদ গেলেও দলে থাকা ওপেনার সৌম্যকে না নিয়ে নেওয়া হয়েছে নাঈম শেখকে। সৌম্যকে বাদ দেওয়ার যুক্তিও অবশ্য পূর্ববর্তী সিরিজ ধরে দেওয়া যায়।

নিউজিল্যান্ডে সৌম্যকে টপ অর্ডারে খেলানো হয়েছে। আদর্শ কন্ডিশনে আদর্শ পজিশনে সৌম্য তিন ম্যাচ মিলিয়ে করেছেন ০, ৩২ আর ১! এমন একজনের উপর পুনরায় ভরসা হয়তো টিম ম্যানেজমেন্ট করতে চায়নি। সেক্ষেত্রে নাঈম শেখ ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের জন্যে আরেকটি বিকল্প। অবশ্য নাঈম শেখের অন্তর্ভুক্তিও যুক্তিযুক্ত হবে যদি সামনের সিরিজেই আজকের ম্যাচের জন্যে তাকে বাদ না দেওয়া হয়!

  • চার

বাংলাদেশ ‘দল’ হিসেবে আসলে কেমন সেটা বোঝার আসল মওকা ছিল তৃতীয় ওয়ানডে। ঘরের মাঠে ২৬০ এর বেশি রান দল তাড়া করতে পারে কিনা এটাই ছিল মূলত দেখার বিষয়। সেই পরীক্ষাতে দল উতরে যেতে পারেনি। সাথে একটা বার্তাও রেখে গেছে বাংলাদেশ। ছোটখাট এসব দলের সাথে জিততে পারলেও বাংলাদেশ এখনও বড় দলগুলির জন্যে তৈরি নয়। ২-১ এ সিরিজ জিতে তাই এটা স্রেফ একটা সিরিজ জয় হয়েই থাকবে, এখানে কোন সুখানুভূতি থাকা কাম্য নয়। দুশমন্থ চামিরার পেসের বিপক্ষে দলের ব্যাটসম্যানেরা যেভাবে ধুকেছে সেটা একটা প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই তুলে দেয়, বড় আসরে বড় পেসারদের পেস সামলাতে পারবে তো বাংলাদেশ?

পারার কথা অবশ্য নয়। ঘরের মাঠে এমন সিরিজ আমরা আগেও জিতেছি। ফাকফোকরে সমস্যা রেখে আমরাও হারিয়েছি সফরকারীদের। এভাবেই আমরা ভেবেছিলাম, ২০১৯ বিশ্বকাপ ভাল খেলব, জিতে যাব (!)। কিন্তু বিশ্বকাপ আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, এভাবে জিতে আসলে ঘরের মাঠে সিরিজ জেতা যায়। বড় দল হওয়া যায়না।

এখন বাংলাদেশ দল কি চায়? বাংলাদেশ দলের লক্ষ্য কি? সেটা কি শুধুই সিরিজ জয় নাকি নিজেদেরকে আরো একধাপ উপরে নেওয়া। আমরা যখন ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলেছিলাম, সেই বিশ্বকাপের পর আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলাম। সেই পরিকল্পনা ছিল আমরা ঘরের মাঠে সিরিজগুলি জেতার চেষ্টা করব। আজ ৫ বছরের বেশি সময় পরে আমাদের সেই পরিকল্পনা বদলানো দরকার ছিল। লোয়ার অর্ডারে এত বছর খেলার পর রিয়াদের স্ট্রাইক রেট কেন এত কম সেটা প্রশ্ন করার দরকার ছিল।

২৬০+ তাড়া করতে গিয়ে তামিমের গড় কেন ১৭ এর আশেপাশে সেটা ভাবা দরকার ছিল। স্পিনার হিসেবে বাইরে আমাদের সার্ভিস দিতে পারবে এমনভাবে মিরাজকে তৈরি করা দরকার ছিল। সামনের বড় আসরগুলিকে পাখির চোখ করার দরকার ছিল। কিন্তু আমরা সেটা করছিনা। আমরা ঘরের মাঠে সিরিজ জিতেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি। সে হিসেবে বলতে হয়, এখানে কুশল পেরেরার দলের বিপক্ষে জিতলেও সামনে বাংলাদেশকে খেলতে হবে বিরাট কোহলির দলের সাথেই!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link