অনন্য ইমরান খান ও নিস্বার্থ ভালবাসা

পাকিস্তানকে সেই স্বপ্নের শিরোপা এনে দেওয়ার পূর্বেই ইমরান খান দেখিয়েছেন দলের প্রতি তাঁর নিবেদন। নিজের বিদায়ী টেস্ট সিরিজে তিনি দেখিয়েছিলেন শক্তিকার অর্থেই পেশাদারিত্ব। স্পোর্টসম্যানশীপের অনন্য নজির তিনি রেখে যান ক্রিকেট ইতিহাসে। 

‘নিজের চাইতে দল বড়’। যেকোন দলগত খেলায় এই বাক্যটি রীতিমত অমর বাণী। তবে এই বাক্যের প্রমাণ ঠিক কতটুকু রাখতে পারেন খেলোয়াড়রা? অধিকাংশ খেলোয়াড়ের মনের গহীন কোণে নিজের পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ করবার একটা সুপ্ত বাসনা থাকেই। তবে যারা নিজেকে ছাপিয়ে দলকে উপরে রাখেন তাঁরা নিশ্চয়ই কিংবদন্তি। আর তেমনই একজন কিংবদন্তি ইমরান খান।

পাকিস্তান ক্রিকেটের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার নায়ক তিনি। তাঁর অধিনায়কত্বেই তো ১৯৯২ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছিল পাকিস্তান। সেখান থেকেই যেন দেশটির ক্রিকেটের নব উত্থান। অবশ্য পাকিস্তানকে সেই স্বপ্নের শিরোপা এনে দেওয়ার পূর্বেই ইমরান খান দেখিয়েছেন দলের প্রতি তাঁর নিবেদন। নিজের বিদায়ী টেস্ট সিরিজে তিনি দেখিয়েছিলেন শক্তিকার অর্থেই পেশাদারিত্ব। স্পোর্টসম্যানশীপের অনন্য নজির তিনি রেখে যান ক্রিকেট ইতিহাসে।

ঘটনাটা ১৯৯১ সালের শেষ দিকে। সেবার শ্রীলঙ্কাকে ঘরের মাঠে আতিথিয়েতা দিয়েছিল পাকিস্তান। টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় শিয়ালকোটে। প্রথম ইনিংসে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি লংকান ব্যাটাররা। পাকিস্তানি বোলারদের দাপটে মাত্র ২৭০ রানেই গুটিয়ে যায় লংকানরা। ওয়াকার ইউনুস সে ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন। শ্রীলঙ্কার পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৭ রান এসেছিল সানাথ জয়সুরিয়ার ব্যাট থেকে।

জবাবে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তান দারুণ সূচনা পায়। ১২৮ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়েন শোয়েব মোহাম্মদ ও রমিজ রাজা। সেই জুটিই পাকিস্তানকে বড় সংগ্রহের ভীত গড়ে দেয়। রমিজ রাজা দুই রানের জন্যে নিজের সেঞ্চুরি হাতছাড়া করেন। তবে সালিম মালিক ঠিকই নিজের সেঞ্চুরি আদায় করে নেন।

ব্যাটারদের দৃঢ়তায় দারুণভাবে এগিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানের ইনিংস। অধিনায়ক ইমরান খান সেদিন ছয় নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। ব্যাট হাতে সেই টেস্টে দারুণ করছিলেন ইমরান খান। মনে মনে হয়ত ঠিক করেই রেখেছিলেন, সেই টেস্ট সিরিজ খেলেই তিনি সাদা পোশাক তুলে রাখবেন। তাইতো ব্যাট আর বলে সমানতালেই পারফরম করে বিদায়ী সিরিজটি রাঙিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।

ইমরান খান সেটা পেরেছেন। তিনি রাঙিয়ে গেছেন। তিনি উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। তিনি তাঁর উত্তরসূরীদের একটা বার্তা দিয়ে গেছেন। দল সবার আগে। ছয় নম্বরে নেমে শ্রীলঙ্কার বোলারদের বিপক্ষে তিনি ব্যাট হাতে বেশ স্বস্তির সময় পার করছিলেন। এমনকি ওয়াসিম আকরামকে সঙ্গী করে একটা পঞ্চাশোর্ধ জুটিও গড়ে ফেলেন ইমরান।

তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইমরান খান ইনিংস ঘোষণা করে দেন দলীয় ৪২৩ রানে। না সেখানে অবাক হওয়ার মত তেমন কিছু নেই। কারণ সকল বিস্ময় তো ইমরান খানকে ঘিরে। নিজের সপ্তম টেস্ট সেঞ্চুরির একেবারেই দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইমরান খান। তিনি যখন অধিনায়ক হিসেবে ইনিংস ঘোষণা করেন তখন তাঁর ব্যক্তিগত রান ৯৫। তৃতীয় দিনের খেলা কেবল চলমান তখন।

সবাই হয়ত ভেবেই বসেছিল ইমরান খানের শতক হবে, এরপর পাকিস্তান ইনিংস ঘোষণা করবে। কিন্তু অধিনায়ক ইমরান খান নিজেকে অমর করে রেখে গেলেন ক্রিকেটের ইতিহাসে। বিশ্ব ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে এমন নজির নেই, যেখানে নব্বইয়ের ঘরে ব্যাট করতে থাকা কোন অধিনায়ক ইনিংস ডিক্লিয়ার করে দিয়েছেন।

ঠিক এমন ঘটনার মঞ্চায়ন করার দুই ম্যাচ বাদেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান ইমরান খান। অবশ্য তখন তাঁর পাকিস্তান ক্রিকেটকে আরও কিছু দেওয়ার বাকি ছিল। সেটা তিনি উসুল করে দেন রঙিন পোশাকে। এই ঘটনার পরের বছর ১৯৯২ সালে তিনি পাকিস্তানকে দেন বিশ্ব জয়ের স্বাদ। এরপর এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হয়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানান ইমরান খান।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...