দুই ঘন্টা বাইশ মিনিট- ক্রিকেট সেদিন এই সময়েই দেখেছিল যা কিছু অসম্ভব এ পৃথিবীতে, যা কিছু উচ্চাসনে রাখা যায়। অনিল কুম্বলে- ১৯৯৯ সালের সাত ফেব্রুয়ারি সাদা পোশাকের এক ইনিংসে নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের গোটা দশটাই। অনিল কুম্বলের এই আকাশ ছোঁয়া পর্যন্ত যে রেকর্ড ছিল কেবল মাত্র জিম লেকারের।
ফিরোজ শাহ কোটলার পিচ এমনিতেই স্পিনের দিকে একটু বেশি ঝুঁকে থাকে। সেদিনও ধূলাবালিতে স্পিনের পক্ষেই বেশি কথা বলছিল। সেই পিচে ভারতের প্রথম ইনিংসের রানও খুব বেশি সুবিধার ছিল না। কিন্তু তাতে কি , দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ ব্যাট করে সে টেস্টে পাকিস্তানকে বেশ শক্ত একটা লক্ষ্যই বেঁধে দিয়েছিল ভারত- ৪২০! টেস্ট ক্রিকেটে ততদিনে এই লক্ষ্য তাড়া করে কেউ চতুর্থ ইনিংসে জয় পায়নি।
যা হোক, পাকিস্তান সেই লক্ষ্য তাড়া করতে ওপেনিংয়ে পাঠায় সাঈদ আনোয়ার আর শহীদ আফ্রিদিকে। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার ছিল, যত কঠিনই হোক না কেন একটা চেষ্টা করতে হবে। সাঈদ আনোয়ার আর আফ্রিদিকেও সেদিন বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগছিল শুরু থেকেই। আর কুম্বলে? লাঞ্চ পর্যন্ত তিনি সম্ভবত আঁচও করতে পারেননি আর কিছুক্ষণ পর কি দুর্দান্ত এক মুহুর্তই না কাটাতে যাচ্ছেন তিনি! তা আঁচ পাবেনই বা কী করে? লাঞ্চ বিরতিতে আম্পায়ারের বেল ফেলে দেবার সময় অনিল কুম্বলের বোলিং ফিগার- ৬ ওভারে কোন উইকেট ছাড়াই ২৭ রান, পাকিস্তানেরও পড়েনি একটা উইকেটও!
লাঞ্চ বিরতির পর ম্যাচ নিয়ে তখন বেশ বিপাকে পড়ে গেল ভারত। দ্রুতই তাঁরা বুঝতে পারল এই পিচে একমাত্র অনিল কুম্বলেই যা একটু পার্থক্য গড়ে দিতে পারবেন। কিন্তু গোটা একটা টেস্ট ম্যাচ জেতাতে অনিল কুম্বলে একা কিই বা করতে পারেন? তিনি কি আর একাই দশ উইকেট নেবেন?
এরকম একটা চিন্তা করে কুম্বলে যখন তাঁর লাঞ্চ ব্রেকের পরের স্পেলের তৃতীয় ওভার করতে নামছেন, পাকিস্তান সবেমাত্র কোন উইকেট ছাড়াই একশো পার করেছে। ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে শোনা যাচ্ছে , পাকিস্তান শেষ ইনিংসের লক্ষ্য তাড়া করার নতুন একটা রেকর্ড করেও ফেলতে পারে। খুব সম্ভবত, পাকিস্তান আনপ্রেডিক্টেবল বলে খুব জোর দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছিল না। কিন্তু যেকোন কিছুই তো হতে পারে!
- দশে দশ
কুম্বলের সেই ওভারের তৃতীয় বলে তিনি অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল ফেললেন, ক্রিজে থাকা আফ্রিদি ব্যাট চালালেন , মৃদু একটা শব্দ তুলে বল পিছে চলে গেল, উইকেট কিপার নয়ন মোঙ্গিয়া বল ধরেই আপিল করে ফেললেন। অপরপ্রান্তে থাকা আম্পায়ার অরণি ভেলাউধাম জয়প্রকাশ আঙুল তুলে দিলে পাকিস্তানের প্রথম উইকেট পড়ে যায়!
আফ্রিদিকে অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল। ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম তো তখন চালু ছিল না। আফ্রিদিরও তাই কিছু করার ছিল না। মাথা নাড়াতে নাড়াতে কিছু একটা আওড়াতে আওড়াতে তিনি ফিরে গেলেন প্যাভিলিয়নে। পরে অনেকবার তিনি দাবি করেছেন এটা ব্যাটে লাগেনি, কিন্তু কুম্বলে বারবারই বলেছেন এটা বড়সড় এজই ছিল। সে যা হোক, ১০১ রানের মাথাতে পাকিস্তান তাদের প্রথম উইকেট হারিয়ে ফেলে আর কুম্বলে তাঁর ঐতিহাসিক অর্জনের প্রথম লম্ফ দিয়ে ফেলেন- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি নয়!
আফ্রিদি ফিরে গেলেন, ক্রিজে এলেন ইজাজ আহমেদ। নতুন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তিনি বলটা একটু মাঝে ফেলেন, ফিরোজ শাহ কোটলার পিচে তা সোজা গিয়ে আঘাত হানে ইজাজ আহমেদের প্যাডে। এবারও আবেদন আর আম্পায়ার জয়প্রকাশ আঙুল তুলে দিলেন- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি আট!
আরো পড়তে পারেন
অনিল কুম্বলে তখন হ্যাট-ট্রিকে আছেন। আর একটিমাত্র উইকেট পেলেই দানে দানে হয়ে যাবে তিন দান। কিন্তু ক্রিজে আসা ইনজামাম উল হক হ্যাট-ট্রিক হতে দিলেন না। কিন্তু তিনিও ক্রিজে থাকতে পারলেন না বেশিক্ষণ। অনিল কুম্বলের গুড লেংথে করা একটি শর্ট বল গিয়ে সোজা আঘাত করে ইনজামামের উইকেটে। ১০০ রানে কোন উইকেট না হারানো পাকিস্তানের ৩ উইকেট পড়ে যায় ১১৫ রানের মাথায়- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি সাত!
বিপাকে থাকা পাকিস্তানের বিপদ আরো বাড়িয়ে দেন মোহাম্মদ ইউসুফ। ইউসুফকে তুলে নেওয়া উইকেটটায় কুম্বলের ডেলিভারিটা ছিল সচারচর তাঁর অন্য ডেলিভারির চাইতে দ্রুতগতির। সেই দ্রুত আসা ডেলিভারি খেলতে গিয়ে ভুল লাইনে ব্যাট চালান মোহাম্মদ ইউসুফ, বল সোজা গিয়ে আঘাত করে ইউসুফের প্যাডে, আরেকটি লেগ বিফোর উইকেট- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি ছয়!
মঈন খান স্পিনের বিপক্ষে ভাল খেলেন বলে সুনাম ছিল, সেলিম মালিকও ছিলেন ইনজুরিতে । মঈন খানকে তাই ব্যাটিং অর্ডারে উপরে তুলে আনা হয় । কিন্তু তিনিও ফিরোজ শাহ কোটলার দুর্বোধ্য পিচে বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না। পাকিস্তানের ১২৭ রানের মাথায় কুম্বলের এক লিফটারে , সামনের দিকে বল পুশ করতে গিয়ে তিনি স্লিপে থাকা সৌরভ গাঙ্গুলীর তালুবন্দী হন। একটু আগে যাদের মহাকাব্যিক লক্ষ তাড়া করার কথা বলা হচ্ছিল তারাই কিনা ১১২৭ রানের মাথায় নিজেদের অর্ধেক উইকেট হারিয়ে ফেলেন, কুম্বলেও পেয়ে যান ইনিংসে পাঁচ উইকেট- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি পাঁচ!
পাকিস্তানের দশ উইকেট পড়ে গেলেও তখনও ক্রিজে ছিলেন সাঈদ আনোয়ার। সাঈদ আনোয়ারের গল্পটা এর পরের ওভারের। দারুণ ব্যাট করতে থাকা আনোয়ারের জন্যে কুম্বলে এক ফন্দি আঁটেন। তিনি রাউন্ড দ্যা উইকেটে বল করে পিচের বাজে জায়গা, যেটা কিনা ছিল আনোয়ারের অফ স্ট্যাম্পে ,সেখানে বল ফেলেন। কিন্তু কুম্বলের এই পরিকল্পনা সফল হয়না। তিনি আবারও ওভার দ্যা উইকেটে ফিরে আসেন, আর এবার একেবারেই ধীরগতির এক লেগ স্পিন ডেলিভারি দেন। বল মোটামুটি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছিল আনোয়ারের কাছে, আর এরপর তা আনোয়ারের ব্যাটে চুমু দিয়ে শর্ট লেগে দাঁড়ানো ভিভিএস লক্ষণের তালুবন্দী হয়- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি চার!
কুম্বলে পরে বলেছেন এই উইকেট নেওয়ার পরই তাঁর মাথায় এসেছে তিনি দশ উইকেটের সবগুলোই হয়তো নিতে পারবেন। কিন্তু এরপর সেলিম মালিক আর ওয়াসিম আকরাম প্রতিরোধ গড়লে কুম্বলের অপেক্ষা বাড়তে থাকে, একসময় চা বিরতির সময় হয়ে যায়। তা সেটা তো ভালই ছিল কুম্বলে জন্যে, একটু সতেজও তো হওয়া দরকার!
চা বিরতির পর অনিল কুম্বলে তাঁর ইতিহাস গড়ার মিশনে নেমে পড়েন আবার। সেলিম মালিক এমনিতেই ইনজুরিতে ছিলেন। কুম্বলে তাঁর জন্যে ডেলিভারিও দিলেন শর্ট লেংথে। খাটো লেংথের এই ডেলিভারি পেয়ে পুল করতে গেলেন সেলিম মালিক, কিন্তু বল তিনি যতটা উঠবে ভেবছিলেন ততটা উঠল না আর তা সোজা গিয়ে আঘাত হানল সেলিমের স্ট্যাম্পে, হাঁটতে হাঁটতে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন সেলিম মালিক- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি তিন!
চার ওভার পর- মুস্তাক আহমেদ কাঁধের ওপরে আসা ডেলিভারিটা খেলতে গিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের হাতে ধরা পড়েছেন। আর এরপরই সাকলাইন মুস্তাকও কোটলার পিচে ধেয়ে আসা স্পিন সোজা খেলতে যাবার ভুল করে প্যাডে বল লাগিয়ে বসেন। মাত্র ১৯৮ রানের মাথায় ৯ উইকেট পড়ে যায় পাকিস্তানের।কুম্বলে তখন অপেক্ষায়- হারাধনের দশটি ছেলে রইল বাকি এক!
এসময় কুম্বলে আরেক ফন্দি তৈরি করেন। তিনি চাচ্ছিলেন ক্রিজে থাকা ওয়াসিম আকরাম সিঙ্গেল নিক আর ওয়াকাস ইউনুস পিচে আসুক। কিন্তু আকরাম কোনভাবেই সিঙ্গেল না নেওয়ায় তিনি তাঁর পরিকল্পনা বদলে ফেলেন। তবে আকরামের জন্যে কুম্বলের ডেলিভারিটা আহামরি ছিল না। খুবই গোবেচারা ধরণের লেগ স্পিনে তিনি শর্ট লেগে থাকা লক্ষণের হাতে ক্যাচ দিয়ে বসেন- হারাধনের দশটি ছেলে রইল না বাকি কেউ!
অনিল কুম্বলে ততক্ষণে ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন, যে অস্পর্শী প্রতিমা জিম লেকারের পর কেউ ছুঁতে পারেনি তা ছুঁয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন অনিল কুম্বলে। ফিরোজ শাহ কোটলার ২৫ হাজার দর্শক ততক্ষণে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে যেন। স্টেডিয়ামের বাইরে কাকে যেন সাপুড়েদের বাঁশি হাতে উন্মাদ-নৃত্য জুড়ে দিতে দেখা গেল। স্টেডিয়ামের ভিতরেও পাগলের মত সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছেন – ‘কুম্বলে… কুম্বলে’।
সতীর্থরা কুম্বলেকে ঘিরে রেখে প্যাভিলিয়নে ফিরে আসছেন। ফিরোজ শাহ কোটলার দর্শকেরা বেড়ার কাছে চলে এসেছেন, মহানায়ককে, ইতিহাসের পাতায় থাকা এই দুর্বোধ্য লেগ স্পিনারকে যদি একবার একটু দেখা যায়, একবার একটু ছোঁয়া যায়। এক দর্শক হঠাৎ করে কুম্বলের শার্ট ধরে টান দিলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। সিকিউরিটি অফিশিয়ালদের একজন রীতিমত মারামারি জুড়ে দিলেন দর্শকের সাথে।
তা, এ তো হবারই। কুম্বলে পুরো এক দিনে যা দেখিয়েছেন, যা করে ফেলেছেন, ফিরোজ শাহ কোটলার তো উন্মাদই হয়ে যাওয়ার কথা। অতিরিক্ত প্রেমে তো মানুষ পাগলই হয়ে যায় তাইনা?