ভ্রাতৃত্বের ফুটবল

কথায় আছে ভাইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। ভাই মানেই একে অপরের ভরসার জায়গা। কিন্তু সেই ভাই যখন হয়ে উঠে মাঠের সতীর্থ, তখন তা হয়ে উঠে অন্যরকম একটা জুটি।

কথায় আছে ভাইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। ভাই মানেই একে অপরের ভরসার জায়গা। কিন্তু সেই ভাই যখন হয়ে উঠে মাঠের সতীর্থ, তখন তা হয়ে উঠে অন্যরকম একটা জুটি। এমনই কয়েকটি সেরা সহোদর জুটি নিয়ে আজকের লেখা।

  • রোনাল্ড ও আরউইন কোম্যান

দুই ভাইয়ের মধ্যে রোনাল্ড চাইলেই নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন। কেনই বা করবেন না। আরউইনের ক্যারিয়ার আগে শুরু হলেও পথে চলতে চলতে কতটা এগিয়ে গিয়েছেন রোনাল্ড। আয়াক্স, বার্সার জার্সিতে খেলেছেন ভাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণবার খেলেছেন নেদারল্যান্ডের জার্সিতে।

দুজনের ক্যারিয়ারই শুরু হয়েছিল গ্রোনিগেনের জার্সিতে। আরউইন পুরো ক্যারিয়ার কাটিয়ে দিয়েছেন নেদারল্যান্ডেই। কিন্তু রোনাল্ড তার ক্যারিয়ার নেদারল্যান্ডে শেষ করে হয়েছেন বার্সেলোনা লিজেন্ড। জিতেছেন চারটি লা লিগা, বার্সেলোনাকে জিতিয়েছেন প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ। ক্যারিয়ারও শেষ করেছেন বেটার নোটে। দুই ভাই ১৯৮৮ ইউরো জিতেছিলেন নেদারল্যান্ডসের হয়ে।

কিন্তু কোচিং ক্যারিয়ারে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন রোনাল্ড। আরউইন-রোনাল্ড জুটি করে কোচিং করিয়েছেন সাউদাম্পটন এবং এভারটনে। রোনাল্ডের সহকারী ছিলেন আরউইন। কিন্তু এরপর নেদারল্যান্ডের পর বার্সার কোচ হয়েছেন রোনাল্ড। যদিও প্যান্ডেমিকের পর থেকে কোনো দলের সাথে নেই আরউইন।

শুধু দুই ভাই নয়, এমনকি তাদের বাবা মার্টিন কোম্যানও ডাচদের জার্সিতে খেলেছিলেন একটি ম্যাচ।

  • ফ্রাঙ্কো ও জুসেপ্পি বারেসি

অন্য ভাই জুটির মধ্যে এই ভাইদের গল্প একটু আলাদা। অন্য ভাইয়েরা একই দলের হয়ে খেলেছেন, জার্সি শেয়ার করেছে। কিন্তু এই দুই ভাই ছিলেন আজীবনের শত্রু। বাড়িতে নিজের পরিবার পর্যন্ত ফুটবলের কথা তুলতো না যখন দুজনে বাড়িতে থাকতেন।

ছোটবেলায় দুজনেই চেষ্টা করেছিলেন এক দলে ঢোকার জন্য। কিন্তু ইন্টার মিলানে ট্রায়াল দিয়ে সুযোগ পান একমাত্র জুসেপ্পি। কিন্তু রাইভাল এসি মিলানে ট্রায়াল দিয়ে সুযোগ পেয়ে যান ফ্রাঙ্কো। এরপর থেকে শুরু হয় তাদের সবচেয়ে বড় রাইভালরি। নিজেদের বাড়িতে ২০ বছরের বিশাল রাইভালরি।

পরের দুই দশক ধরে এই জুটি তাদের নিজ নিজ ক্লাবের ট্রেডমার্ক। দুজনেই তুলে নেন নিজেদের ক্লাবের ক্যাপ্টেন্সির আর্মব্যান্ড। দুই সহোদর হয়ে উঠেছিলেন দুই দলের তারকা।

যদিও দুই ভাইয়ের মধ্যে সফল ছিলেন ছোট ভাই ফ্রাঙ্কো। প্রায়শই তাকে ফুটবলের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার হিসাবে ধরা হয়। পুরো ক্যারিয়ার খেলেছিলেন মিলানে। কিন্তু জুসেপ্পির শেষ দুই বছর কেটেছিল ম্যাডোনাতে। পুরো ক্যারিয়ার ইতালিতে থাকা দুই ভাইয়ের মধ্যে ফ্রাঙ্কো জিতেছিলেন সাতটি সিরি-আ আর জুসেপ্পি মাত্র দুটি জিতেছিলেন।

  • ফিল ও গ্যারি নেভিল

প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে বিখ্যাত, এবং সবচেয়ে সফল সহোদর জুটি হচ্ছে নেভিল ব্রাদার্স জুটি। এই দুই ভাই ছিলেন স্যার অ্যালেক্সের বিখ্যা ‘ক্লাস অফ ৯২’ এর অংশ। দুজনেই ছিলেন রেড ডেভিলদের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ছোট ভাই ফিলের জায়গা আগে নিশ্চিত হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুম থেকেই তিনি দলের মূল সদস্য। আর গ্যারির অভিষেক হয় পরের মৌসুমে ফিলকে বেঞ্চে বসিয়ে। যদিও বাকি ক্যারিয়ার দুজনের খেলেছেন হাতে হার রেখে, ইউনাইটেডের জট পাকানো ডিফেন্সের অংশ হয়ে।

যদিও ক্যারিয়ারের শেষভাগে ফিল ইউনাইটেড ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন এভারটনে। কিন্তু গ্যারি নিজের ক্যারিয়ার চালিয়ে যান ফার্গুসনের অধীনেই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে সেন্টার ব্যাকের জীবন শেষ করেন ১৯ বছরের ক্যারিয়ার। হন ইউনাইটেডের ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’।

দুই ভাই একসাথে জিতেছেন ছয়টি প্রিমিয়ার লিগ। (গ্যারি পরে আরো দুটি জিতেছিলেন), তিনটি এফএ কাপ, একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি। (গ্যারি জিতেছেন আরেকটি)

অবসর নেওয়ার পরেও দুই ভাই ছাড়তে পারেননি ফুটবলের মায়া। কোচ-ধারাভাষ্যকার হিসেবে ফুটবলের আশেপাশেই থাকতে থাকেন। গ্যারি ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের সহকারী কোচ এবং ভ্যালেন্সিয়া এফসির কোচ হয়েছিলেন। কিন্তু রেকর্ডবুকে কিছু যুক্ত করতে না পারায় এখন পুরোপুরি ধারাভাষ্যকার। অন্যদিকে ফিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, সালফোর্ড সিটি ও ভ্যালেন্সিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন অনেকদিন। এখন ডেভিড বেকহ্যামের তৈরি করা ইন্টার মায়ামি ক্লাবের কোচ তিনি।

  • ববি ও জ্যাক চার্লটন

কিংবদন্তি ফুটবল ভাইদের কথা বললে, এই দু;জনের নাম আসবে সবার উপরে। কেনই বা আসবে না। নাক উঁচু ব্রিটিশদের আজীবনের আক্ষেপ, তারা নিজেদের খেলায় কোনো না কোনোভাবে পা হড়কায়। কিন্তু যেবার তারা পা হড়কায়নি, সেবারই তাদের দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন এই দুই ভাই। ববি চার্লটন ও জ্যাক চার্লটন। দুজনেই ছিলেন ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ইংল্যান্ড দলের সদস্য।

দুই ভাই ছিলেন দুই এলাকার সদস্য। ববি ছিলেন আক্রমণভাগের নেতা আর জ্যাক ছিলেন ডিফেন্সের উস্তাদ। দুজনে অবশ্য কখনই একসাথে এক ক্লাবে খেলেননি। জ্যাক ছিলেন লিডস ইউনাইটেডের ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’, অন্যদিকে ববি ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের লিজেন্ড। যদিও ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে অন্য কিছু ক্লাবের জার্সিও গায়ে জড়িয়েছেন ববি।

দুজনেই ছিলেন নিজ নিজ জায়গায় সফল। জ্যাক ছিলেন লিডসের স্বর্ণযুগের সদস্য। প্রথম বিভাগের শিরোপা, এফএ কাপ, লীগ কাপ সবই ছিল তার ঝুলিতে। অন্যদিকে ববি ছিলেন বিখ্যাত ‘বাসবি বেইবস’-এর সদস্য। ১৯৫৮ মিউনিখ দূর্ধটনা থেকে কপালগুনে বেঁচে যান তিনি। এরপর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে আবারও আগের জায়গায় ফেরত আনতে বেশ বড় ভূমিকা রাখেন ববি। ক্যারিয়ারে ২৬০ এর বেশি গোল করা ববি জিতেছেন ব্যালন ডি’অর।

তবে তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য জাতীয় দলের জার্সিতে, ১৯৬৬ বিশ্বকাপে। জ্যাক যেখানে সামলেছিলেন ডিফেন্স, সেখানে একের পর এক গোল করেছেন ববি। দুজনে ছিলেন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ের সারথি। দুজনেই পেয়েছেন ইংলিশ সরকার থেকে সম্মান। জ্যাক নিজের ক্যারিয়ার শুরুর আগে আর্মিতে থাকার কারণে আলাদা সম্মানও পেয়েছেন। কিন্তু তাদের জুটি ভাই-ভাও জুটির মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয়।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...