ফুটবল বিশ্ব থমকে গিয়েছিল সেদিন

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল মানেই অন্য রকম এক উত্তেজনা। প্রতিটি মিনিটজুড়ে অন্য রকম এক শিহরণ। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে এমনই এক দিনে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বাজে ঘটনার সম্মূখীন হয়েছিল ফুটবল বিশ্ব। বিশ্ব দেখেছিল কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর হুলিগানিজমের চূড়ান্তরূপ আর তার ফলাফল!

ইউরোপিয়ান ফুটবল মৌসুমের শেষপ্রান্তে এসেই সাধারণত উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। আর একেকটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের সাথে লেখা থাকে বহু কষ্ট, পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ের গল্প। দিনটা আনন্দের, যারা জেতে তাঁদের জীবনেরই হয়তো সবচেয়ে স্মরণীয় দিন সেটা।

তবে, কিছু কিছু দিন আলাদা হয়। সেদিন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের দিন লেখা হয়েছিল এক শোকগাঁথা। আনন্দ পরিণত হয়েছিল বেদনায়। তেমনই একটি দিন হল ২৯ মে, ১৯৮৫।

বেলসিয়ামের ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়াম। তখনও চ্যাম্পিয়নস লিগ এর তকমা লাগেনি ইউরোপিয়ান কাপের গায়ে। বরং পরিচিত ছিল ইউরোপিয়ান কাপ নামেই। আর সেখানেই ফাইনালেই মুখোমুখি হয়েছিল জিওভান্নি ত্রপাত্তোনির জুভেন্টাস এবং জো ফ্যাগানের লিভারপুল। ইতালি আর ইংল্যান্ডের সেরা দুই দল মুখোমুখি বেলজিয়ামে। কিন্তু কে জানতো এই দিন পরিণত হতে চলেছে বেদনায়?

সেবারের ফাইনালের জন্য নির্ধারিত ছিল বেলজিয়ামের জাতীয় স্টেডিয়াম হেইসেল স্টেডিয়াম। প্রায় ৫ বছর এর পুরোনো স্টেডিয়ামটি ছিল উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। নিয়মিত সংস্কার না করায় স্টেডিয়ামের কিছু জায়গায় ক্ষত তৈরি হয়েছিল।

এক জায়গায় এমনই ক্ষত হয়েছিল যে সেটি ভেঙ্গে বাইরে থেকে মাঠে দর্শক প্রবেশ করতে পারত। গ্যালারির বিভিন্ন অংশ ছিল ভাঙ্গা। তা সত্ত্বেও জুভেন্টাস লিভারপুলের হেভিওয়েট ম্যাচ ফেলা হয় এই মাঠেই। আগের বছরই এই মাঠে খেলে গিয়েছিল আর্সেনাল, বরং বারবার বলেছিল, এই মাঠ খেলার যোগ্য নয়।

ম্যাচের কয়েকদিন আগে মাঠ পরিদর্শন করে দুই ক্লাবের কর্তারাও বলেন মাঠ পরিবর্তন করতে। কিন্তু সে কথা কানেই নেয়নি ইউয়েফা। ইউরোপের সেরা মাঠগুলো খালি থাকলেও ম্যাচ গড়ায় হেইসেল স্টেডিয়ামেই। পরে জানা গিয়েছে এই মাঠের ইন্সপেকশনে সময় নেওয়া হয়েছিল মাত্র ৩০ মিনিট।

যথা সময়েই মাঠে গড়ায় ম্যাচ। আগে থেকেই দর্শকরা ভিড়তে থাকে মাঠে। রাত ৮টায় ম্যাচ শুরু হলেও ৫টা থেকেই ভিড়তে থাকে দর্শকেরা। মাঠের ধারণক্ষমতা ছিল মোটে ৫৮ থেকে ৬০ হাজার। জুভেন্টাস ও লিভারপুল; দুই দলের সমর্থকেরাই বেশ আগ্রাসী। সে বুঝে তাদের জন্য নির্দিষ্ট টিকিট ভাগ করে দেওয়া হয় দুই পাশে।

জুভেন্টাসের জন্য বরাদ্দ ছিল O, N & M জোন এবং লিভারপুলের জন্য X, Y & Z জোন৷ কিন্তু পুরো জোনটা তাদের দেওয়া হয়নি। বরং Z জোন ছিল নিরপেক্ষ দর্শকদের জন্য। বেলজিয়ামের যারা খেলা দেখতে আসবেন, তারা খেলা দেখতে পারবেন এখান থেকে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়লো যে জুভেন্টাস সমর্থকদের জন্য মাঠে বেশি সিট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দুই দলের জন্যই ২৫ হাজার সিট বুক থাকার কথা থাকলেও লিভারপুল তার থেকে বেশ কম পেয়েছিল। সে থেকে একটা ক্ষোভ ছিলই।

সেই Z জোন দখল করেছিল ব্রাসেলসে থাকা ইতালিয়ান কমিউনিটি। লিভারপুল সমর্থকদের পাশেই বড় একটা অংশের টিকিট নিয়েছিল তারা। সেই সাথে আগের মৌসুমের ফাইনালে রোমায় লিভারপুল সমর্থকদের উপর আক্রমণের কথা ভুলে যায়নি তারা। তাই বেশ সতর্ক ছিল স্টেডিয়াম সিকিউরিটি। তাই দুই দলের মাঝখানে নিউট্রাল জোনে ছিল প্রায় ৩০ জন পুলিশ ও চেইন লিঙ্ক।

সন্ধ্যা ৭টার দিকেই স্টেডিয়াম টইটম্বুর হয়ে যায় দর্শকে। খেলা শুরু হবার তখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তখনই ছড়িয়ে পরে উত্তেজনা। পাশাপাশি থাকা X জোনের লিভারপুল সমর্থকেরা ফ্লেয়ার, বোতল এবং ইটের ভাঙ্গা টুকরো ছুঁড়তে থাকে Z জোনে থাকা জুভেন্টাস ও নিরপেক্ষ সমর্থকদের দিকে। সময় যত এগোচ্ছিল ততই বাড়ছিল ঝামেলা। একটা সময় X ও Z জোনের মাঝখানের বেড়া ভেঙে লিভারপুল ফ্যানরা চড়াও হয় জুভেন্টাস ফ্যানদের দিকে। পুলিশি বাঁধা কোনো কাজেই আসে না। তাদের তোয়াক্কা না করেই আক্রমণ করে বসে জুভেন্তাস সমর্থকদের দিকে।

প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও আস্তে আস্তে পেছাতে থাকে জুভেন্টাস সমর্থকেরা। লিভারপুল ফ্যানদের তাড়া খেয়েই Z জোনের কংক্রিট  দেয়ালের দিকে চলে যায় জুভেন্টাস সমর্থকরা ৷ কিন্তু দেওয়ালের অবস্থা ছিল শোচনীয়। কোনমতে দেওয়ালটি দাঁড়িয়ে ছিল দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। ফলে সাথে সাথেই ভেঙে পরে দেওয়াল। আর সেখানেই সলিল সমাধি হয় ৩৯ জন সমর্থকের।

যার মধ্যে ছিলেন ৩২ জন ইতালিয়ান, ৪ জন বেলজিয়ান, ২ জন ফ্রেঞ্চ এবং একজন নর্দান আয়ারল্যান্ডের নাগরিক। সেই সাথে আহত হয় প্রায় ৬০০ জন সমর্থক। সাথে সাথেই চড়াও হয় পুলিশ, গ্রেফতার করে ৩৪ জন, যার মধ্যে ১৪ জন ছিলেন লিভারপুল সমর্থক, যাদের গ্রেফতার করা হয় খুনের দায়ে।

সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা ছিল যে, এত বড় দূর্ঘটনার পর সকলেই ভেবে নিয়েছিল ম্যাচ বোধহয় বাতিল করা হবে। কিন্তু না, ব্রাসেলসের মেয়র, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী এসে উল্টো চাপ দিতে শুরু করলেন ম্যাচ শুরু করার জন্য। তাদের মতে দর্শকদের মন মানসিকতা অনেক খারাপ, আর সেটা দূর করতে খেলা শুরু হওয়া বেশ জরুরি। বলতে গেলে একপ্রকার জোর করেই দুই দলের অধিনায়ককে পাঠানো হল খেলা শুরু করতে।

আর দর্শকদের শান্ত করতে দুই অধিনায়কই ম্যাচ শুরুর আগে কথা বললেন। তাদেরকে জানানো হয়েছিল এটা নিছক একটা দূর্ঘটনা আর হতাহতের সংখ্যাও বেশি নয়। কোনো মৃত্যুর খবর না জেনেই মাঠে নামলো দুই দল। জুভেন্টাস কোনো কষ্ট ছাড়াই ম্যাচ নিজেদের করে নেয়, ৫৯ মিনিটে মিশেল প্লাতিনির পেনাল্টিতে একমাত্র গোলে ১-০ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে জুভেন্টাস। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল সেটা।

দুই দলের কেউই পুরো ঘটনা জানতো না। ফলে ম্যাচ শেষে স্বাভাবিকভাবেই মাঠ ছাড়ে দুই দল। কিন্তু মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার সময় রাস্তায় অবরোধ দেখে ঘটনা আন্দাজ করতে পারে দুই দল। দুই দলকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় বিমানবন্দরে, দুই দলই ম্যাচ শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেকের মধ্যে দেশ ছাড়েন।

পরদিনই শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে পুরো দোষ দেওয়া হয় লিভারপুল সমর্থকদের ঘাড়ে। তদন্ত চলে প্রায় দেড় বছর। এরপর ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয় আদালত। আর সেই রায়ে ১৪ জনের ৩ বছরের ও ৪ জনের ৫ বছরের কারাদন্ড হয়। সেই সাথে আজীবনের জন্য মাঠ থেকে নিষিদ্ধ হয় ৩৪ জনই।

এই ঘটনার পর ইউয়েফা ইউরোপিয়ান কাপ থেকে ইংলিশ ক্লাবগুলোকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। আর লিভারপুলকে ছয় বছরের জন্য। বলতে গেলে এই ঘটনার পর থেকেই লিভারপুলের দুর্ভাগ্য শুরু হয়। এরপর থেকেই প্রায় ৩০ বছর লিগ শিরোপার দেখা পায়নি তারা।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততেও লেগেছে প্রায় ২১ বছর। শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ডের ক্লাবদের ব্যান করার কারণে ইউয়েফার কান্ট্রি র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থান থেকে একেবারে বাদই পরে যায় ইংল্যান্ড। শীর্ষস্থানে ফিরতে ২০০৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের।

অন্যদিকে, এই ম্যাচের পর থেকেই দর্শকদের কর্মকান্ডের উপর জোরাজুরি শুরু করে ইউয়েফা। দর্শকদের আচরণের প্রতি কড়া নজর রাখা হয়। এমনকি দর্শকদের নিষিদ্ধও করা হয় মাঠ থেকে। এই ঘটনার পর ১৯৮৯ সালে হিলসবোরো ডিজাস্টারের সম্মুখীন হয় লিভারপুল।

এরপর থেকে স্টেডিয়ামের ব্যাপারেও কড়াকড়ি শুরু হয়। প্রতিটি নিয়ম না মানলে কোনোভাবেই খেলা গড়াবে না মাঠে। যে কারণে দুই বছর আগে নিজেদের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে পারেনি আতালান্তা, তাদের ধার করতে হয়েছিল সান সিরো স্টেডিয়াম। নতুন করে তৈরি করা হয় হেইসেল স্টেডিয়াম। আর যার সামনে দূর্বিসহ এক স্মৃতি হয়ে আছে একটা প্রতীকী।

হেইসেল স্টেডিয়াম দূর্ঘটনা একটা প্রতীকী মাত্র, সকল ফুটবল সমর্থকদের সামনে। কীভাবে কর্তৃপক্ষের একটু অবহেলা আর দর্শকদের আগ্রাসী মনোভাব মুহূর্তেই বদলে দিতে পারে ফুটবল ম্যাচের চিত্র। ফুটবলে হুলিগানিজম কতটা বাজে হতে পারে তার উদাহরণ ছিল ১৯৮৫ সালের সেই দিনটি। ফুটবলে কেন, খেলাধুলার কোনো ক্ষেত্রেই এমন দিন যেন আর কাউকে না দেখতে হয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...