বিস্মৃত এক গতিদানবের গোলমেলে জীবন

জেফ ডুজনের ব্যাপারে তো ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশ ভালই জানা। তর্কযোগ্যসাপেক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক মানা হয় তাঁকে। এক অনুষ্ঠানে ডুজনকে ভরা মজলিসে প্রশ্ন করা হল - তাঁর সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী বোলার কে ছিলেন? সবার ধারণা ছিল ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিংদের মধ্য থেকেই কারও নাম হয়ত বলবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন প্যাট্রিক প্যাটারসনের নাম।

কিংস্টনের এক তলার একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরেসান। খানিকক্ষণ বাদে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ৫৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ লোক। সুন্দরেসান অবশ্য তাঁকে চেনেন। ২৫ বছর বাদে দেখছেন। এত বছরেও যেন একটুও বদলাননি তিনি।

আগের মতই লম্বা; তবে আগের চেয়ে অনেকটা দুর্বল। গায়ে ঢিলেঢালা লম্বা শার্ট, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট; মাথায় একটি টুপি আর মুখে হাসির ঝিলিক। চোখে এখনও অতীতের সেই ভয়ংকর চাহনিটা স্পষ্ট। মাঝের দাঁতটা না থাকায় দেখতে এখনও আগের মতই লাগছে।

এই মানুষটাকেই ছয় বছর যাবৎ খুঁজে ফিরছেন সুন্দরেসান। কত কিছু শুনেছেন তিনি। মানুষটা নাকি আর নেই – এমনটাও শুনেছিলেন। তবে এসবে তিনি মোটেও কর্ণপাত করেননি। খুঁজতে খুঁজতে পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। অনেকটা অসম্ভবকে যেন সম্ভব করে খুঁজে পেয়েছেন তাঁকে।

সুন্দরেসানের কথায় বাড়ির সামনে বুড়োটা দাঁড়িয়ে পড়লেন ছবি তোলার জন্য। ফোঁকলা দাঁতের হাসিতেও স্পষ্ট ফুটে উঠছিল তাঁর করুণ অবস্থা। বাড়ির ভেতরে যাওয়ার বড্ড ইচ্ছে ছিল সুন্দরেসানের। কিন্তু, বুড়ো লোকটা নিষেধ করলেন। দু:খ প্রকাশ করে বললেন, ‘না, এই অনুমতি আমি দিতে পারছি না।’

অগ্যতা একটা ট্যাক্সি নিয়ে বিমানবন্দরের কাছে একটা বারে যাওয়ার জন্য ছুঁটলেন তিনি। ওই এলাকার অবস্থাও ভয়াবহ। নোংরা, দূর্গন্ধ, বস্তির মত অবস্থা। ৫৫ বছর বয়সী বুড়োটা বলতে থাকলেন, ‘আগে এমন ছিল না। একটা সময় এলাকাটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বেশ খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে।’

একটা বারে পরের চার ঘন্টা কাটলো। বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে লোকটার জীবনের উত্থান-পতন, সফলতা আর অন্ধকারে কাটানো দিন – সব ব্যাপারেই কথা হল। সময় যতই বাড়ছে লোকটা ভেতরের সব কথা বের করে আনার চেষ্টা করছেন সুন্দরেসান। নারীরাও যে এখন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে খেলছেন – সেটিও তিনি জানেন না। হুট করে আবার জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন এত বছর পর ইসরাইল সফর করছেন।’

লোকটার এমন উদ্ভট উদ্ভট কথায় যেন হকচকিয়ে যাচ্ছিলেন সুন্দরেসান। ঠিক কোন কথা থেকে কোন কথায় যাচ্ছেন সেটি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। মাঝে বলে উঠলেন, পরের বার আসলে নাকি বুড়োটা তাঁকে পুরো কিংস্টন ঘুরে দেখাতে লং ড্রাইভে নিয়ে যাবেন। লোকটার অবশ্য একটি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে; বছর দশের মত অব্যবহৃত হয়ে বাড়ির এক কোণে পড়ে আছে। জানালেন বাড়ির বাকি জিনিসগুলোর মত গাড়িটাও হয়ত নষ্ট হয়ে গেছে।

জেফ ডুজনের ব্যাপারে তো ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশ ভালই জানা। তর্কযোগ্যসাপেক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক মানা হয় তাঁকে। এক অনুষ্ঠানে ডুজনকে ভরা মজলিসে প্রশ্ন করা হল – তাঁর সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী বোলার কে ছিলেন? সবার ধারণা ছিল ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিংদের মধ্য থেকেই কারও নাম হয়ত বলবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন প্যাট্রিক প্যাটারসনের নাম।

১৯৮০ সালের দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই অঞ্চল জ্যামাইকা ও বার্বাডোজের মাঝে একটি মিনি-টেস্ট আয়োজন করা হয়। ওই দুই অঞ্চলের ম্যাচকে সেসময় ক্রিকেটের ডার্বি বলা হত। দুই দলেই ছিল তুখোড় তুখোড় সব পেসার। বার্বাডোজের হয়ে জোয়েল গার্নার, মার্শাল ছিলেন। বিপরীতে মাইকেল হোল্ডিং, কোর্টনি ওয়ালশ ও প্যাট্রিক প্যাটারসন ছিলেন জ্যামাইকায়। সেদিন গতির ঝড়ে বার্বাডোজকে একাই উঁড়িয়ে দিয়েছিলেন প্যাটারসন। বলা হয়, ওই টেস্ট একা হাতেই জিতিয়ে দেন তিনি।

প্যাটারসন ছিলেন রগচটা। পেসারদের মধ্যে আগ্রাসী ভাবটা এমনিতেই কম-বেশ থাকে। ১৯৮৮ সালের মেলবোর্ন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বেশ দারুণ খেলছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্টিভ ওয়াহ অনবরত বাউন্সার দিচ্ছিলেন, সাথে স্লেজিং তো ছিলই।

ওই ইনিংসে ওয়াহ পাঁচ উইকেট নেন আর প্যাটারসনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করেন। এতেই চটে যান প্যাটারসন। দিনের খেলা শেষে সোজা চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুমে। অজি ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘এর জবাবটা কাল তোমাদের দিতে হবে। আমি তোমাদের শেষ করে ফেলবো।’

ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। অগ্নিঝড়া পেস আর বিধ্বংসী বাউন্সে পরের দিনটা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটারদের বুকে কাপুনি ধরিয়ে দিলেন। প্যাটারসনের বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ১১৪ রানে শেষ অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। একাই ৫ উইকেট শিকার করেন এই ডানহাতি পেসার।

এ ব্যাপারে ওয়াহ পরবর্তীতে নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘প্যাটারসনের বোলিং দেখে মনে হত বিশাল কোনো কিছু আমার দিকে ধেয়ে আসছে। উইকেটে টিকে থাকাটাই ছিল বড় দায়। ব্যাটারদের ভাবনার অনেকাংশ জুড়ে থাকত প্যাটারসনের বলে ইনজুরির ভয়।’

বারে বসে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে প্যাটারসনের এই ঘটনা গুলো বুড়ো লোকটিকে বলছিলেন সুন্দরেসান। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে এসবের তেমন কোনো স্মৃতি লোকটির মনে নেই। কিন্তু প্যাটারসনের গল্প-ই বা এই লোককে বলছেন কেন সুন্দরেসান? প্যাটারসনের সাথেই বা তাঁর কি সম্পর্ক! এসব প্রশ্ন মনে নিশ্চই দাগ কাটছে?

হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে; নিবিড় এক সম্পর্ক। বারে বসে সুন্দরেসানের সাথে গল্পে মেতে উঠা এই বুড়ো লোকটি ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের একসময়ের তারকা পেসার প্যাট্রিক প্যাটারসন।

মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল অ্যান্ডি রবার্টস, কোর্টনি ওয়ালশ – আশি কিংবা নব্বই দশকে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করা এই তারকা পেসারদের কথা হয়ত কারোই অজানা নয়। এই তারকারা যতদিন ক্রিকেট খেলেছেন, ব্যাটারদের জন্য ছিলেন আতংকের নাম। আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই পেসাররা ২২ গজ ত্রাস করেছিল। এই খ্যাতনামা পেসারদের তালিকায় আরও একজন ছিলেন, নাম – প্যাট্রিক প্যাটারসন।

কারো কারো কাছে একেবারেই অচেনা, অজানা এক নাম। আবার কেউ কেউ হয়ত নাম শুনে পুরনো কোনো ক্রিকেটীয় স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করতে পারেন। তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের বিস্মৃত এক প্রতিভাবান গতিদানব। এক সময় ২২ গজে গতির ঝড় তুলে রাজত্ব করেছিলেন।

বাঘা বাঘা ব্যাটারদের মাত দিয়েছেন গতি দিয়ে। ক্রিকেট ইতিহাসে তাঁর অবদান কিংবা বোলিং নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়; আবার হয় না বললেও ভুল হবে না। এক সময় ২২ গজ ত্রাস করা প্যাট্রিক প্যাটারসনকে আসলেই কারো মনে আছে কি?

প্রশ্নটা খানিকটা পালটে দেই। প্যাট্রিক নিজেকে মনে রেখেছেন তো?

উত্তরটাও ইতিমধ্যেই হয়ত পেয়ে গেছেন। একসময় গতির ঝড় তুলে ২২ গজে যে ভয়াবহ গর্জন তুলে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করেছেন – সেটি তিনি নিজেও যেন ভুলে বসেছেন।

১৯৯৩ সালে শৃঙখলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে বাদ পরেছিলেন। এরপর বছর কয়েক ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। ধীরে ধীরে বিষন্নতা পুরপুরি গ্রাস করে ফেলে। মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। কিন্তু কাউকে কিছু জানান নি। একদিন হঠাৎ পরিবার, বন্ধু, ক্রিকেট সব ছেড়ে দূরে চলে গেলেন। লোকালয় থেকে দূরে, পরিবার-আত্মীয় স্বজন ছেড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

কোনো হদিস নেই, কেউ জানেন না তিনি কোথায়! বেঁচে আছেন কি-না সেটিও অজানা। কারো কাছে তিনি মৃত, কারো মতে তিনি আছেন কোনো এক পাগলা গারদে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কেউ সন্ধান মেলাতে পারলেন না। ২২ গজ দাপিয়ে বেড়ানো লম্বা-চওড়া, সুঠাম দেহের এক মানব হঠাৎ যেন পৃথিবীর বুক থেকেই হাওয়া হয়ে গেছেন!

অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে একটা সময় পর সবাই হাল ছেড়ে দিলেন। প্যাটারসন নামক অধ্যায়ের বোধহয় এখানেই সমাপ্তি। রহস্যের মধ্যে দিয়েই কি তাহলে প্যাটারসন অধ্যায় শেষ? ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই পেসার যে তখন সবার কাছে অস্তিত্বহীন!

সবাই হাল ছেড়ে দিলেন। শুধু হাল ছাড়েননি একজন। ৫৫ বছর বয়সী বুড়োটাকে যিনি ছয় বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছেন। হ্যাঁ, সুন্দরেসান। পুরো নাম ভরত সুন্দরেসান। বেশ অচেনা, অজানা একজন। অবশ্য পাঠকদের কাছে এই নামটা এতক্ষণে পরিচিত হয়ে গেছে। তাঁর সবচেয়ে ভাল পরিচয় – তিনি ক্রীড়াঙ্গনের একজন সত্যিকার প্রেমিক, একজন ক্রীড়া সাংবাদিক।

সব ছেড়ে তিনি পণ করেছিলেন খুঁজে বের করবেন প্যাটারসনকে। বছর পঁচিশের মত খোঁজ নেই মানুষটার। ততদিনে তাকে সবাই ভুলেও গেছে। কিন্তু ভুলে যাননি সুন্দরেসান। পুরো জ্যামাইকা জুড়ে খুঁজে গেছেন তিনি। কত তথ্য, কত সূত্র ধরে এগিয়েছেন – কিন্তু ফলাফল শূন্য।

তবু লেগে রইলেন। ২০১১ সাল থেকে খুঁজতে খুঁজতে ছয় বছরেও প্যাটারসন রহস্যের কোনো সুরাহা করতে পারলেন না। এরপর হুট করে আশার আলো দেখলেন। ২০১৭ সালে বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে সন্ধান পেলেন প্যাটারসন বেঁচে আছেন। এরপর হন্তদন্ত হয়ে পাড়ি জমালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিনবারের চেষ্টায় প্যাটারসনের সাথে সাক্ষাতের পথ বের করলেন।

গল্পের এক পর্যায়ে পুরনো কিছু স্মৃতি যেন মনে পড়ে গেল প্যাটারসনের। ভারতের অরুণ লালকে আউট করেছিলেন। বলতে শুরু করলেন, ‘কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত – কি ভয়ংকর ব্যাটার ছিল; তাঁকে আউট না করতে পারাটা ছিল বিপজ্জনক। সে আর ডেভিড বুন আমাকে অন্যদের তুলনায় বেশ সহজেই মোকাবেলা করেছিল। আজহারউদ্দিনের সাথেও আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। সে কি এখন কোচিং করায় নাকি?’

সুন্দরেসান বোলিংয়ের প্রসঙ্গ আনতেই এক চিমটি হাসি দেখা গেল প্যাটারসনের মুখে। নিজের নিখুঁত পেস বোলিংয়ের ব্যাপারে বললেন, ‘এটা ঈশ্বর প্রদত্ত ছিল। একটা সময় পর ধীরে ধীরে সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। আমার জীবনের সবকিছু তখন ভিন্ন দিকে যাচ্ছিল।’

২০১১ সালে প্যাটারসনকে প্রথম খোঁজা শুরু করেন সুন্দরেসান। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ছিল ভার‍ত। শেষ ম্যাচটা ছিল জ্যামাইকাতে। সেই সুযোগে দশদিন সময় পেয়েছিলেন প্যাটারসনকে খুঁজতে। তবে, প্যাটারসনের ব্যাপারে কোনো সূত্রই খুঁজে পেলেন না।

এর বছর দুয়েক পর ২০১৩ সালে আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ভারত। এবার অবশ্য জ্যামাইকার গন্ডি পেরিয়ে কিংস্টন অবধি প্যাটারসনকে খোঁজা শুরু করলেন। জ্যামাইকার পোর্টল্যান্ড অঞ্চলের হেক্টর নদীর পাশেই এক গ্রামে বেড়ে উঠেন প্যাটারসন। সেখানেও খোঁজ নিয়ে কোনো তথ্য পেলেননা সুন্দরেসান। এমনকি বাবা-মাও জানেন না ছেলে আদৌ বেঁচে আছে কিনা!

কোর্টনি, একজন আমেরিকান নাবিক; যিনি মানুষ খোঁজ করতে বেশ পটু। বিভিন্ন সূত্র ধরে শেষমেশ কোর্টনির কাছেই সাহায্য চাইলেন সুন্দরেসান। এটা ছিল কোর্টনির আরেক ব্যবসা। তবে বহু হারিয়ে যাওয়া লোকের সন্ধান তিনি এনে দিয়েছিলেন এটাও ঠিক। কোর্টনি আবার একজন ক্রিকেটপ্রেমীও ছিলেন। ক্রিকেটপ্রেমীর চেয়ে সোবার্সপ্রেমী বলাই ভাল। গ্যারি সোবার্সের বড় ভক্ত ছিলেন। যার জন্য সোবার্সের অবসরের পর কোর্টনিও ক্রিকেট দেখা ছেড়ে দেন!

প্যাটারসনের সন্ধান পেতে কোর্টনি আবার আরেক বন্ধু ফ্রেড লকসের সাথে যোগাযোগ করেন। ৬৭ বছর বয়সী ফ্রেড ছিলেন বেশ প্রখ্যাত একজন সঙ্গীতশিল্পী। তিনি যে এলাকাতে থাকতেন এর বেশ কাছেই ছিলেন প্যাটারসন। লকস অবশ্য সুন্দরেসানকে দেখেই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল, ‘এমন একজন মানসিক রোগীর সাথে তুমি কেন দেখা করতে চাও?’

লকসের সহযোগিতায় প্যাটারসনের ফোন নাম্বারটাও পাওয়া গেল। তবে, প্রথম দু’দিন চেষ্টা করেও প্যাটারসনের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেলেন না। সুন্দরেসানের সাথে দেখা করার আগে প্যাটারসন খানিকটা প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলেন।

অবশেষে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে দু’দিন বাদে কিছু সময়ের জন্য দেখা করতে রাজি করালেন প্যাটারসনকে। প্রায় ৪৮ ঘন্টা পেরোবার পর এবার সাক্ষাতের পালা। প্রথমে অবশ্য সাক্ষাৎকার দিতে অনীহা দেখাচ্ছিলেন। ছয় বছরের শ্রম কি বৃথা যেতে পারে? প্রায় ৪৫ মিনিট চেষ্টা করে সফল হলেন সুন্দরেসান।

সেদিন ক্যারিবীয়দের ডেরায় আবার ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের পঞ্চম ওয়ানডে চলছিল। খানিকটা সময় সুন্দরেসানের কাছ থেকে ম্যাচের স্কোর আপডেট নিলেন। এরপর জানালেন, বর্তমান সময়ের ক্যারিবীয় ক্রিকেটারদের কাউকে নাকি তিনি চেনেন না। অবশ্য যে লোকটা নিজেকেই ঠিকভাবে মনে রাখতে পারেননি, তিনি এখনকার ক্রিকেটারদের চিনতে পারবেন না – সেটাই তো বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার।

পরবর্তী আবার দেখায় প্যাটারসনের সাথে বেশ কিছু সময় কাটান সুন্দরেসান। এবার অবশ্য প্যাটারসন নিজেই তৈরি ছিলেন সাক্ষাতের জন্য। এই লোকটিকে খুঁজতে এক সাংবাদিক এত কিছু করেছে – এই ব্যাপারটা প্যাটারসনের হৃদয়কে স্পর্শ করে।

এবার নিজ থেকেই গল্প শোনাতে লাগলেন। পোর্টল্যান্ডে নিজ গ্রামে ছেলেবেলা থেকে ক্রিকেট দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন। তিনি সবসময়ই চাইতেন, বোলিং করবেন। অবশ্য ব্যাটার হিসেবেও নিজেকে কল্পনা করতেন প্রায়ই। নিজের স্কুলের হয়ে এক ম্যাচে ওপেনিংয়েও খেলেছেন। বোলিং অ্যাকশনটা ন্যাচারালি ছিল। তবে, হাই লেগ-লিফটের কারণে বলে গতি আর বাউন্সটা দিতে পারতেন সবার চেয়ে বেশি। সেখান থেকে ছুঁটে আসেন কিংস্টনে; আর এখানেই দেখা পান কোর্টনি ওয়ালশের।

স্কুল ক্রিকেটে দু’জনে জুটি বেঁধে বোলিংও করেছেন। দিনে দিনে প্যাটারসনের গতি আরও বাড়তে থাকে। সেখান থেকেই জ্যামাইকার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকও হয়। এরপর ইংল্যান্ডের স্যাডলওর্থ লিগে খেলার সুযোগ পান। যেটিকে অত্যন্ত নিন্মমানের লিগ হিসেবে আখ্যা দেন। ৬০-৭০ বছরের বুড়োদের সাথেও নাকি খেলতে হয়েছিল সেখানে! তাও আবার প্রাপ্য অর্থের বেশ সামান্যই পেয়েছিলেন তিনি।

সাবেক পাকিস্তানী ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরামের বাড়িতেও একবার গিয়েছিলেন। সেখানে ওয়াসিমের আতিথিয়েতায় মুগ্ধ হয়ে যান প্যাটারসন।

একবার অস্ট্রেলিয়ায় তাসমানিয়ার হয়ে শেফিল্ড শিল্ড খেলতে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি বঞ্চনার শিকার হন। থাকার জন্য দল থেকে কোনো রুমের ব্যবস্থাই করা হয়নি তাঁর জন্য। ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি প্রতি পদে পদে অবহেলার শিকার হয়েছিলেন। এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, নিজের শোবার ঘরের দেওয়ালে বড় করে লিখে রাখতেন – ‘ Injustice (অবিচার)। ‘

১৯৯২-৯৩ অস্ট্রেলিয়া সিরিজে শৃঙখলা ভঙ্গের দায়ে বাদ পড়েছিলেন। এরপর আর ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি। ক্রিকেট মাঠে প্রতিপক্ষকে নিজের পেস আর বাউন্সে মাত দিয়েছে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। কিন্তু তিনি কখনোই স্বস্তিতে ছিলেন না। অবহেলার বাক্সে যেন তিনি বন্দি থাকতেন সবসময়। বাদ পড়ার পর বছর পাঁচেকের মত ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজ দল জ্যামাইকার হয়ে কিছু ম্যাচে খেলেছিলেন।

মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। একদিন হুট করেই সব ছেড়ে চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। ২৫ বছর ধরে এভাবেই আড়াল করে রাখলেন নিজেকে। কোনো রকমে খেয়ে, না খেয়ে বেঁচে আছেন। উন্নত জীবনযাত্রার কোনো ছিটেফোঁটাও ছিল না।

বেশ কিছু সময় ছিলেন মানসিক আশ্রমে। নিজের ব্যাপারে ছড়ানো সব গুজব তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। এসব শোনার পর আর তিনি ফিরে আসেননি। তিনি ভেবে নিয়েছিলেন তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতেই সবার এমন প্র‍য়াস ছিল। ধীরে ধীরে আরও ভেঙে পড়েন তিনি। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। বছরের পর বছর এভাবে থেকে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

কোনো এক শক্তি তাঁকে সবসময় প্রতিহত কর‍তে সর্বদা চেষ্টা করছে – এমনটাই ভাবতেন প্যাটারসন। সুন্দরেসানের সাথে গল্পের মাঝে তাঁকেও বেশ সতর্ক করলেন। যে-ই সাহায্যর চেষ্টা করতে আসবে, তার বিপদ হতে পারে বলেও সতর্ক বার্তা দিলেন প্যাটারসন।

এবার বিদায়ের পালা। গাড়ি থেকে নামতে নামতে সুন্দরেসানের হাত ধরে বুড়োটা এবার বললেন, ‘আমি কখনো কারও সাথে এত কথা বলিনি। তুমি আসায় আমি বেশ খুশি হয়েছি। এসব তো আর টাকা দিয়ে কেনা যায় না।’

বিদায়ের আগে শেষবার প্যাটারসনের দিকে তাকালেন সুন্দরেসান। এবার মাথায় অবশ্য টুপিটা নেই। এলোমেলো চুল আর একগাল হাসি। অনেক বছর আগে এই মানুষটাকে ২২ গজে দেখেই আঁতকে উঠতেন ব্যাটাররা। সুন্দরেসান হাসিমুখে বললেন, ‘আমি বাড়ি ফিরেও আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব।’

প্যাটারসন তখন কাছে এসে জবাব দিলেন, ‘ভুলে যেও না কিন্তু কেউ আমাদের শুনছে। আমার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। তুমি জানো আমার জন্য এই ব্যাপারগুলো সহজ না। আমাকে বিশ্বাস করো।’

সত্যিই! মানুষটা এমন হয়ে গেছেন, বিশ্বাস হয় না!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...