রজার বিনি, কর্মময় এক ‘অলরাউন্ডার’ জীবন

মাঠের পাশাপাশি  মাঠের বাইরের ভূমিকাতেও সমান সফল তিনি। খেলোয়াড়, কোচ, পরামর্শক, নির্বাচক, প্রশাসক সকল ভূমিকাতেই তিনি সফল। সব সময়ে নীরবে নিভৃতে নিজের দায়িত্বটা পালন করে গেছেন আপন মহিমায়। 

বিশ্বকাপজয়ী, অধিনায়ক, নির্বাচক, ক্রিকেট প্রশাসক – এক অঙ্গে বহুরূপ কথাটি বোধহয় তাঁর জন্যই প্রযোজ্য। প্রথমবারের মতো দেশকে এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের স্বাদ, পরবর্তীতে অধিনায়কত্বও করেছেন। খেলা ছাড়ার পর ছিলেন জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক, জহুরির চোখে হিরে খুঁজে বের করতেন হাজারো ক্রিকেটারের মাঝে থাকে।

সম্প্রতি অধিষ্ঠিত হয়েছেন ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে। বলছিলাম বিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত নতুন সভাপতি রজার বিনির কথা, যার হাত ধরে নতুন যুগে প্রবেশের স্বপ্ন দেখছে ভারত। 

মাত্র এক সপ্তাহ আগেও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন রজার বিনি। খেলোয়াড়ি জীবন কিংবা নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে থাকলেও জীবনের পড়ন্ত বেলায় খানিকটা নিভৃতেই বেঙ্গালুরুতে নিজ বাড়িতে থাকতেন।

সারাজীবন সংবাদমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় শেষবেলায় খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন, যাতায়াত করতেন পাবলিক বাসে। এ প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ‘এটা আভিজাত্য কিংবা বিলাসিতার প্রশ্ন না, আমি বরং এভাবেই বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করি।’

এককথায় রজার বিনি মানুষটা এমনই – বাস্তববাদী, ছিমছাম। ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রায় ১৬ বছর চুটিয়ে খেলেছেন কর্ণাটক এবং গোয়ার হয়ে। তবে তাঁকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপ, সেবার যেন সুনীল গাভাস্কার কিংবা কপিল দেবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রায়।

১৮ উইকেট নিয়ে দলকে বিশ্বকাপ জেতানোর পাশাপাশি ছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। মাঠের পাশাপাশি  মাঠের বাইরের ভূমিকাতেও সমান সফল তিনি। খেলোয়াড়, কোচ, পরামর্শক, নির্বাচক, প্রশাসক সকল ভূমিকাতেই তিনি সফল। সব সময়ে নীরবে নিভৃতে নিজের দায়িত্বটা পালন করে গেছেন আপন মহিমায়। 

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্ম তাঁর। ছয় ভাইয়ের সাথে খেলাধুলা করেই ধীরেধীরে বড় হয়ে উঠা। ব্যানসন টাউনের রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে খেলতেই একদিন আলো ছড়িয়েছেন লর্ডসে। ভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ব্যানসন টাউন জায়গাটার আবেদন অন্যরকম, বেশিরভাগ লোক চেনে চ্যাম্পিয়ন এলাকা নামে।

জ্যাভেলিন থ্রো, ডিস্কাস থ্রো, হাই জাম্প, লং জাম্পসহ ভু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের তারকার আঁতুড়ঘর এই ব্যানসন টাউন। তবে বিনি সবসময় ক্রিকেটারই হতে চাইতেন। ১৯৭৩ সালে কোচবিহার ট্রফিতে খেলার মধ্য দিয়ে পেশাদার ক্রিকেটে আগমণ তাঁর। 

দুই বছর পর রঞ্জি ট্রফিতে কর্ণাটকের হয়ে কেরালার বিপক্ষে অভিষেক। ক্যারিয়ারে ব্যাট কিংবা বল হাতে দলকে জিতিয়েছেন বহু ম্যাচ। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদে ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো ডাক পান জাতীয় দলে। ঘরের মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বিনির। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ দিয়ে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার পূর্বে জাতীয় দলের হয়ে ২৭ টেস্টের পাশাপাশি খেলেছেন ৭২ ওডিয়াই ম্যাচ। 

পূর্ব আফ্রিকার ফ্রাসাত আলি এবং পাকিস্তানের মাজিদ খানের পর মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিনির রেকর্ড রয়েছে জাতীয় দলের হয়ে ব্যাটিং এবং বোলিং এ ওপেন করার। অসাধারণ নেতৃত্বগুণের জন্য খেলা ছাড়ার পর নিযুক্ত হন কর্ণাটক ক্রিকেট দলের ম্যানেজার হিসেবে।

তাঁর নেতৃত্বগুণ নিয়ে একবার ভারতের সাবেক পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ বলেছিলেন, ‘অনিল এবং আমি খুবই ভাগ্যবান বিনির অধীনে খেলতে পেরে। সবসময় খেলোয়াড়দের কাঁধে হাত রেখে ভরসা জোগাতেন, কিছুই চাপিয়ে দিতেন না। অধিনায়ক হিসেবে দলের কাছে তাঁর চাওয়া ছিল বাস্তবসম্মত, যা কিনা আমাদের ক্যারিয়ারকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি খেলোয়াড়দের চাপে না ফেলেই তাঁদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে জানতেন।’

কোচ হিসেবে বিনির সেরা সাফল্য ছিল ২০০০ সালের অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ জয়। ছোটদের বিশ্বকাপে সেটাই ছিল ভারতের প্রথম সাফল্য। সেই দল থেকেই উঠে এসেছিলেন যুবরাজ সিং, মোহাম্মদ কাইফের মতো অসাধারন সব ক্রিকেটাররা। 

এরপর প্রধান নির্বাচক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিন বছর। তাঁর ছেলে স্টুয়ার্ট বিনি জাতীয় দলে ডাক পেলে তাঁর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছিল একবার। এরপর নির্বাচকের দায়িত্ব ছেড়ে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই দফায় ছিলেন কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

প্রথম দফায় ২০১০ সালে নিযুক্ত হবার পর নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় পদত্যাগ করেন ২০১২ সালে। ২০১৯ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন সভাপতি হিসেবে। দুবারই তিনি ভোটে বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন। এর আগে ১৯৯৭ সালে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন প্রায় দুই বছর। 

কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে সময়ের সেক্রেটারি সিদ্ধার্থ বলেন, ‘বিনি খুবই দক্ষ একজন প্রশাসক। কর্ণাটকের ক্রিকেটকে একদম নিজের হাতে ঢেলে সাজিয়েছেন। তরুণ প্রতিভা তুলে আনার ক্ষেত্রে তিনি অতুলনীয়। ক্রিকেটটাকে তিনি অন্তরে ধারণ করেন।’

এখন দেখার বিষয় সৌরভ গাঙ্গুলির রেখে যাওয়া সভাপতির চেয়ারে কতটা সফল হন ক্রিকেট মাঠের অভিজ্ঞ সেনানী রজার বিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...