মিজানুর রহমান: আড়ালের প্রদীপ

গল্পটা এক হলেও মিজানুরের ঠিক স্টিভ স্মিথ হয়ে ওঠা হয়নি। স্মিথ এখনও মাঝে মধ্যে বল করেন। কিন্তু মিজানুর বোলিং ফিঙ্গারটাই ভেঙে ফেলেছেন; তাই বোলিং আর করতে পারেন না। সবচেয়ে বড় অমিল হলো, স্মিথ এর মধ্যে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন; মিজানুর এখনও ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডিটাই পার হতে পারেননি।

ছিলেন লেগস্পিনার।

লেগস্পিনার হতেই ক্রিকেটে এসেছিলেন। স্বপ্ন ছিলো একজন শেন ওয়ার্ন হয়ে উঠবেন। কিন্তু একদিন কোচ দেখলেন, নিচের দিকে ব্যাট করতে গিয়েও দারুন ভাবে পেস বল সামলাচ্ছেন। দলে তখন ওপেনারের অভাব। তাই কোচ বললেন, ‘কাল তুই ওপেন করবি।’

কোচের কথায় ইনিংস শুরু করতে গিয়ে প্রথম ম্যাচে ঝড়ো ৬৭ রান এবং পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি। ব্যাস, বদলে গেলো তার নিয়তি। লেগস্পিনার হতে এসে হয়ে গেলেন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান।

কী? গল্পটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে? স্টিভ স্মিথ বলে ভুল করছেন?

না, তিনি স্টিভ স্মিথ নন। তিনি একান্তই আমাদের নিজস্ব মিজানুর রহমান।

গল্পটা এক হলেও মিজানুরের ঠিক স্টিভ স্মিথ হয়ে ওঠা হয়নি। স্মিথ এখনও মাঝে মধ্যে বল করেন। কিন্তু মিজানুর বোলিং ফিঙ্গারটাই ভেঙে ফেলেছেন; তাই বোলিং আর করতে পারেন না। সবচেয়ে বড় অমিল হলো, স্মিথ এর মধ্যে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন; মিজানুর এখনও ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডিটাই পার হতে পারেননি।

তারপরও মিজানুর একটা জায়গায় স্টিভ স্মিথ। আপাতত তিনি চলতি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের সেরা ব্যাটসম্যান!

এবারের লিগ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হওয়ায় খুব একটা বড় স্কোরের দেখা মিলছে না। তার মধ্যেও লিগের প্রথম সেঞ্চুরিটা করেছেন এই মিজানুর রহমান। গতকালকের সেই ইনিংস খেলেই মাহমুদুল হাসান জয়কে টপকে গেছেন তিনি। শেষ ইনিংসে ৬৫ বলে ১৩টি চার ও ৩টি ছক্কায় ঠিক ১০০ রান করে অপরাজিত ছিলেন মিজান। ফলে এবার লিগে ১০ ম্যাচে তার রান ৪১৮। ৩৬৭ রান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন জয়। মিজান এবার লিগে ৫২.২৫ গড় এবং ১৩৩.৯৭ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করেছেন।

ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলা মিজান এবার লিগে এর আগে তিন বার ফিফটি পার করেছেন। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে ৭৪, খেলাঘরের বিপক্ষে ৬৬ এবং শাইনপুকুরের বিপক্ষে অপরাজিত ৭৯ রান করেন তিনি।

ঘরোয়া ক্রিকেটে গত কয়েক বছর ধরেই দারুন পরিচিত নাম মিজানুর রহমান। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে বা ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে তার সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন নেই। বলছিলেন, কিভাবে এবার টি-টোয়েন্টিতেও সেই সাফল্যটা ধরে রেখেছেন, ‘করোনার কারণে আমি অনেকদিন খেলার বাইরে। আমি তো লাস্ট বিপিএল বা বঙ্গবন্ধু কাপে টিম পাইনি। ফলে আমার খেলায় ফেরার জন্য নিজেকে ফিট রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম, যে ফরম্যাটেই ফিরি, আমি যেন সেরাটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি। আমি সবসময় মাঠে নামলে সেরাটা দিতে পারি যেনো, সেটা নিশ্চিত করতে চাই।’

মিজানুরের এই নিজেকে তৈরী রাখার শুরু রাজশাহী শহর থেকে।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোয়ার্টারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মিজানুর রহমানের। বাবা ছিলেন এখানকার কর্মকর্তা। কোয়ার্টারের সামনেই টেনিস বলে হাতে খড়ি। আর ছোটবেলাতেই বন্ধু, বড় ভাইদের সাথে ম্যাচ খেলা শুরু। সেখানেই এক বড় ভাই বললেন, ক্রিকেট খেলাটাকে সিরিয়াসলি নিতে।

মূলত তার লেগস্পিনই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি। চাচার এক বন্ধুর কোচিং ছিলো। সেখানেই শুরু হলো ক্রিকেট বলে খেলা; মানে লেগস্পিনার হওয়ার চেষ্টা।

সমস্যাটা হলো, মিজানুর ছিলেন পড়াশোনাতেও ভালো। তাই বাবা-মা নিষেধ করলেন ক্রিকেটের পেছনে ছোটার ব্যাপারে। মিজানুরও জেদ ধরলেন। সোজা বলে দিলেন, ‘ক্রিকেট খেলতে না দিলে পড়াশোনাও করবো না।’

এই জেদের পর আর কী বলার থাকে!

ফলে রাজশাহী বিভাগীয় বয়সভিত্তিক দলগুলোর হয়ে ধাপে ধাপে সারা দেশেই খেলে বেড়াতে শুরু করলেন মিজান। শুরু করলেন, মাইলো অনুর্ধ্ব-১৩ টুর্নামেন্ট থেকে। এই খেলার এক পর্যায়েই ঢাকায় ম্যাচ ছিলো মিজানুরদের। তিনি তখন অনুর্ধ্ব-১৭ দলে খেলছেন। সেই সময় কোচ জামিলুর রহমান সাদ তাকে ওপেনার বানিয়ে ফেললেন। আর ফিরতি ক্যাচ ধরতে গিয়ে যখন আঙুল ভাঙলো, তখন স্রেফ ব্যাটসম্যান হিসেবেই এগোতে শুরু করলেন।

রেকর্ড বলছে, ব্যাটসম্যান হিসেবে এই পথ চলাটা একেবারে খারাপ চলছে না। বাংলাদেশ বয়েজের হয়ে ঢাকায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট দিয়ে শুরু করলেন। ২০০৮ সালে রাজশাহীর হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট এবং লিস্ট-এ খেলা শুরু। ওই বছরই প্রিমিয়ারেও যাত্রা শুরু করেন পারটেক্সের হয়ে।

দেখতে দেখতে এক যুগ পার করে ফেললেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। এর মধ্যে ২০১৬ ও ২০১৭ অসাধারণ সময় কাটিয়েছে। ২০১৭ সালে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে টানা তিন সেঞ্চুরি করে দারুন আলোচনায় এসেছিলেন। সে সময় খবরও প্রকাশ হয়েছিলো যে, জাতীয় দলে চলে আসবেন মিজানুর। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলে জায়গা হয়নি।

মিজানুর স্বীকার করছেন, ওই জায়গা না পাওয়াটা তার জন্য একটা ধাক্কা হয়েছিলো, ‘আমিও ভেবেছিলাম, জাতীয় দলে সত্যিই চলে আসবো। তা না হওয়ায় একটা শক লেগেছিলো। পরের মৌসুমে আমার খেলায়ও সেটার ছাপ পড়েছিলো। কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমার এলাকার বড় ভাই, অমি ভাই (জহুরুল ইসলাম) আমাকে বলেছিলেন, জাতীয় দল নিয়ে ভাবিস না। ওটা ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের খেলাটা খেলে যা। এখন আমি তাই করছি।’

তার মানে অবশ্য এই নয় যে, স্বপ্নটা তুলে রেখেছেন মিজানুর।

২৯ বছর বয়স। তিনি মনে করেন, স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট সময় আছে তার। আবেগী হয়েই বলছিলেন, ‘আমি যেদিন প্রথম ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি, সেদিনই আমার স্বপ্ন লাল-সবুজ জার্সি পরা। কিন্তু সুযোগ পাওয়া তো আমার হাতে নেই। আমি শুধু ভালো খেলে যেতে পারি। দোয়া করবেন, সেটা যেনো ঠিকমত করতে পারি।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...