টি-টোয়েন্টি অ্যাপ্রোচ: কেস স্টাডি বাংলাদেশ

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন হরহামেশাই ১৮০-২০০ রান তাড়া করতে হয়। এখন ১৬০-৭০ রানের টার্গেটে যদি স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে না পারে তাহলে বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচ জিতবেন কিভাবে? সামনের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এই ব্যাপার গুলা আরো স্পষ্ট হবে। আমি জানি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমরা খুব বড় দল নই। তাই বলে একটা দলের মাইন্ডসেট এবং অ্যাপ্রোচতো অবশ্যই ঠিক থাকতে হবে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২-১ এ সিরিজ জয়, প্রশংসায় ভাসছে বাংলাদেশ দল। তবু এই দলের মাইন্ডসেট এবং অ্যাপ্রোচ নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যেকোনো দেশের খেলা ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া প্রতিটা দলই শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে।

কারণ পাওয়ারপ্লে তে একটা ভালো স্কোর দাঁড় করতে পারলে পরবর্তীতে উইকেট পড়লেও শুরুতে বাড়তি রান রেট থাকার কারণে খুব একটা প্রেশারে পড়েতে হয়না। প্রতিটা দলই ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে তাদের অ্যাপ্রোচটা দেখায়। তবে এদিক থেকে আমরা বরাবরই উলটো!

টি-টোয়েন্টিতে বরাবরই আমরা বেশ পিছিয়ে এর একটা বড় কারণ পেশি শক্তি। আমাদের প্লেয়াররা চাইলেই সহজে ছক্কা হাঁকাতে পারেন না। তাই বলে টেকনিক বলতেও তো একটা ব্যাপার আছে? এই জিম্বাবুয়ে সিরিজের কথাই বলি। হারারে স্পোর্টস ক্লাবের বাউন্ডারি অন্যান্য মাঠের তুলনায় বেশ বড়।

জিম্বাবুয়ের প্লেয়াররা পেশি শক্তির দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বড় বাউন্ডারির একটা সুবিধা হলো এতে গ্যাপও তৈরি হয় অনেক। যার ফলে গ্যাপে চার কিংবা সহজেই দুই নেওয়ার সুযোগ থাকে।

কিন্তু, দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে রিয়াদ-মেহেদীদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসাটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগলো। ছক্কা মারতে যেয়ে বেশ কয়েকজনই ওই ম্যাচে বাউন্ডারিতে ধরা পড়ে! অথচ গ্যাপ বুঝে খেলতে পারলে সহজেই রান করতে পারতো। যেটা প্রথম বা শেষ টি-টোয়েন্টিতেই তারা করে দেখাইছে।

আমাদের ব্যাটসম্যানদের মাইন্ডসেট হলো টি-টোয়েন্টি মানেই বলে বলে ছক্কা হাঁকাইতে হবে! সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আরব আমিরাত-দুবাইর বাউন্ডারিও বেশ বড়। সেখানে যদি তাড়াহুড়ো করে ছক্কা মারতে যায় তাহলে আমাদের ব্যাটসম্যানদের শটের যেই পাওয়ার!

অধিকাংশই বাউন্ডারিতে ধরা পড়বে। সেখানে এমন অ্যাপ্রোচ দেখালে মুখ থুবড়ে পড়া লাগবে যেকোনো দলের সামনে। আইপিএলের ম্যাচগুলো খেয়াল করলে দেখবেন এই মাঠ গুলোতে কিন্তু সহজেই কিন্তু গ্যাপ থেকে রান আদায় করা যায়।

জিম্বাবুয়ে এই সিরিজে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুল গুলো দেখায় দিছে। ওরা শুরু থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করছে। একদম ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে। মাঝে উইকেট হারানোর পর ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী উইকেটে কিছুটা সময় ব্যয় এরপর শেষটা দারুণভাবে ফিনিশিং দিয়েছে। টি-টোয়েন্টিতে এই মানসিকতার প্রয়োজন।

প্রথম ম্যাচটার দিকে যদি লক্ষ্য করি ব্যাটসম্যানরা ম্যাচের সিচুয়েশন অনুযায়ীই ব্যাটিং করছে এবং আমরা একটা সহজ জয় পাই। তবে, দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেই তার ঠিক উলটো একটা চিত্র দেখতে পেলাম। ১৬৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে তখন ৪৫ রানে তিন উইকেট!

অবশ্যই ব্যাটিং বিপর্যয় হতেই পারে। সেই সময়ে স্নায়ুচাপ ধরে রেখে উইকেটে কিছু সময় সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে খেলাটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই মূহুর্তে যেকোনো দলই চাইবে আগে উইকেটে কিছুক্ষণ থিতু হয়ে ম্যাচটা ধরা। কিন্তু আমাদের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ আর তরুণ মেহেদী হাসান দু’জনেই একই ওভারে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে উইকেট গিফট করে আসলেন।

ম্যাচের ওই মূহুর্তে ওভার প্রতি ৯.২ এর মতো রান দরকার ছিলো। ওইখানে কিছুক্ষণ উইকেট ধরে রেখে খেলতে পারলে এই ম্যাচটা জেতা কোনো কঠিন কিছু ছিলো না সেটা শামিমের ব্যাটংয়েই প্রমাণ করে। দলের অধিনায়কই যদি এমন অ্যাপ্রোচ দেখায় তাহলে তরুণদের দোষ দিবেন কিভাবে?

আমাদের বড় একটা সমস্যা রান তাড়া করতে গেলে বরাবরই আমরা স্নায়ুচাপটা ধরে রাখতে পারিনা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৮-৯ রান রেট তো অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু এটাকেই আমরা পাহাড়সম একটা লক্ষ্য মনে করি। ওভার প্রতি ৮-১০ রান করতে হলে তো বলে বলে ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টার প্রয়োজন হয়না।

একটা ম্যাচে ব্যাটিং বিপর্যয় হতেই পারে। স্ট্রাইক রোটেটিংয়ে আমাদের দূর্বলতা কখনো কাটবে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় আছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে স্নায়ুচাপ ধরে না রাখতে পারলে এই ফরম্যাটে বড় দলের বিপক্ষে টেকা বড় দুস্কর হবে বাংলাদেশের জন্য। এবং এটার প্রতিফলন সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া সিরিজেই দেখা যাবে!

এবার আসি শেষ ম্যাচে। শুরুতেই নাইম শেখ আউট। দ্বিতীয় উইকেটে সাকিবের একটা ক্যামিও। এরপর সাকিবও আউট! তখন আরেকপ্রান্তে থাকা সৌম্য সরকারের রান ছিলো ৩৭(৩৬)*। সৌম্য শুরুতে ধীরে খেললেও কিন্তু দলের রানরেট তখন প্রায় দশের কাছাকাছি।

পরবর্তীতে সাকিব আউট হওয়ার পর সৌম্য শেষ ১৩ বলে করলো ৩১ রান! এই অ্যাপ্রোচটাই মূলত দরকার ছিলো। ম্যাচের সিচুয়েশন বুঝে ব্যাট চালাইছে। আর সৌম্যর এই ৪৯ বলে ৬৮ রানের ইনিংসটা মূলত ভীত গড়ে দেয়। এখন নাইম শেখ আউট হওয়ার পর সাকিবের সাথে সাথে যদি সৌম্য তেড়েফুঁড়ে মারতে গিয়ে উইকেট দিয়ে আসতো তাহলে সম্ভবত আমরা আগের ম্যাচের চিত্রটাই দেখতে পেতাম!

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখন হরহামেশাই ১৮০-২০০ রান তাড়া করতে হয়। এখন ১৬০-৭০ রানের টার্গেটে যদি স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে না পারে তাহলে বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচ জিতবেন কিভাবে? সামনের অস্ট্রেলিয়া সিরিজে এই ব্যাপার গুলা আরো স্পষ্ট হবে। আমি জানি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আমরা খুব বড় দল নই। তাই বলে একটা দলের মাইন্ডসেট এবং অ্যাপ্রোচতো অবশ্যই ঠিক থাকতে হবে।

টি-টোয়েন্টিতে ভালো করতে হলে অবশ্যই আমাদের অ্যাপ্রোচ এবং মাইন্ডসেটে পরিবর্তন করতে হবে। মান্ধাতা আমলের মতো বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান থাকলে বাঁ-হাতি বোলার আনা যাবে না। ক্রিজে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান থাকলে আরেক বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান নামানো যাবে না। উইকেট পড়তে থাকুক, তবু ছক্কা মারতে উইকেট ছেড়ে বের হয়ে আসতে হবে। এই ধরনের মাইন্ডসেট নিয়ে যদি আমরা খেলতে নামি তাহলে টি-টোয়েন্টিতে আমাদের উন্নতি সম্ভব না।

কোন ম্যাচে কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে খেলবে সেটাই আমাদের প্লেয়ারদের কাছে পরিষ্কার না। এইতো লঙ্কানদের বিপক্ষে সিরিজে দেখেন হারা ম্যাচ দিপক চাহার জিতায় দিছে। অথচ সেকেন্ড টি-টোয়েন্টিতে তিন উইকেট পড়ার পর আমাদের ব্যাটসম্যানদের অ্যাপ্রোচ দেখে মনে হইছে অসম্ভব কোনো এক লক্ষ্য সামনে!

আমরা হারার আগেই হেরে যাই – সমস্যাটা এখানেই। দেখা যাক এখন অপেক্ষা অস্ট্রেলিয়া সিরিজের। ব্যক্তিগত ভাবে চাইবো বাংলাদেশ অন্তত তিন ম্যাচে রান তাড়া করুক। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে যেই ভুলত্রুটি ধরা পড়েনি সেগুলো অজিদের বিপক্ষেই বের হবে নি:সন্দেহে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...