পেস বোলিংয়ের নি:সঙ্গ পতাকাবাহী

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে – কোনো এক বিচিত্র কারণে বেশির ভাগ মানুষের নামের সাথে চরিত্রের একটা সম্পর্ক থাকে। যে মানুষটার নাম দেখবেন ‘ঠাণ্ডা মিয়া’ সেই মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও গোবেচারা কিসিমের হয়। ‘দুরন্ত’ নামের মানুষগুলো একটু বেয়াড়া কিসিমের হয়। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে।

সেই নিয়ম অনুযায়ী শান্ত নামের মানুষেরা শান্তই থাকার কথা। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরু দিকে দলের পেস আক্রমণ দিয়ে প্রতিপক্ষকে অশান্ত করার ভুমিকা ছিল এই মানুষটির। নব্বই দশকে তিনি এক হাতে সামলেছেন বাংলাদেশের পেস বোলিং। পুরো নাম – হাসিবুল হোসেন শান্ত।

বাবা সামরিক বাহিনীর একজন হওয়ায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শৈশব কাটে। এ সময়ে বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটারদের সাথে খেলাধুলা করার কারণে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ গড়ে উঠে। একসময় ঘরোয়া দল মোহামেডানের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন।

সময়ের সাথে সাথে ১৯৯৫ সালে শারজায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। প্রথম ওভারেই রোশান মহানামাকে আউট করে আস্থার প্রতিদানও দেন। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ১১ টি উইকেট নিয়ে সফল হন।

কিন্তু তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে ১ বলে ১ রানের প্রয়োজনটাকে জয়ে রুপান্তরিত করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন এই জয়সূচক রান এনে দেওয়া মাধ্যমে। জয়ের সেই দৃশ্যটা লেখা হয়ে গেছে দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের পাতায়। ফলে, শান্ত নামটা বেঁচে থাকবে চিরকাল।

বাংলাদেশের শুরুর দিকের ম্যাচগুলোতে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেও কিছু রান করেছেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২৬ রানে ২ টি উইকেট পান এবং দলের জয়ে ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম টেষ্টে খেলার সুযোগ পান কিন্তু সফলতা অর্জন করতে পারেন নি। ২০০০ সালেই হাঁটুর আঘাত তার ক্যারিয়ারকে আরো হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এক পর্যায়ে বোলিংয়ের ছন্দ হারিয়ে ফেলায় তার বোলিং এর কার্যকারিতা কমে যায় এবং ২০০৩ সালে দলে নিয়মিত সদস্যের মর্যাদা হারিয়ে ফেলেন।

এরপর ২০০৪ সালে হঠাৎ করে ভারতের বিপক্ষে একটা ম্যাচে খেলা সুযোগ পান। সেটা অবশ্য সম্ভব হয়েছিল কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সুবাদে। নেটে শান্তকে দেখে মনে হয়েছিল, এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাজিমাৎ করতে পারবেন। কিন্তু, হোয়াটমোটকে ভুল প্রমাণ করে শান্ত সেই ৬ ওভারের ৫৩ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি।

কিন্তু একপর্যায়ে ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। প্রতিভার সুবিচার করতে পারেননি। তবে, আজকের মাশরাফি বিন মুর্তজা, রুবেল হোসেন, তাসকিন আহমেদ কিংবা মুস্তাফিজুর রহমানদের মনে রাখা উচিত যে বাংলাদেশের শুরুর ফাস্ট বোলারদের একজন ছিলেন এই হাসিবুল হোসেন শান্ত। এবং অনেক দিন যাবৎ তিনিই দেশের একমাত্র পেস বোলার ছিলেন।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষেও ক্রিকেটের সাথেই যুক্ত আছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) নানারকম পদে কাজ করেছেন। বিশ্বকাপজয়ী অনূর্ধ্ব ১৯ দলের নির্বাচক তিনি। মানে, দু’টি ভিন্ন ভূমিকায় তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অংশ।

১৯৭৭ সালের তিন জুন এই অভাগা বোলারের জন্ম হয়। একই দিনে পেস বোলিংয়ের কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামেরও জন্মদিন। শান্তকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কিংবদন্তি বলার সুযোগ নেই। তবে, পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন নব্বই দশকে বাংলাদেশের বাস্তবতায় তিনি লম্বা সময় দলকে সার্ভিস দিয়েছেন। মাশরাফি আসার আগ পর্যন্ত ফাস্ট বোলিংয়ের পতাকা উড়িয়ে গেছেন।

এই কৃতীত্বটা তাঁকে দিতেই হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link