বাঙালি জনজীবনে সৌরভ গাঙ্গুলির কামব্যাক নিয়ে এখনও আলোচনা হয়। তাঁর প্রতি অবিচার নিয়ে এখনও সরগরম হয় সান্ধ্য আড্ডা। পঙ্কজ রায়ের লড়াই নিয়ে এখনও বয়োজ্যেষ্ঠরা চায়ের কাপে তুফান তোলেন। ময়দানের আনাচে-কানাচে এখনও সম্বরণ বা উৎপল চ্যাটার্জির অসময়ে ক্রিকেট আকাশে আবির্ভাব নিয়ে হাহাকার হয়।
অথচ, ঋদ্ধিমান সাহা বাঙালির ক্রিকেট আড্ডায় এখনও একেবারে শেষ পাতে। তিনি ভালো খেললে ভালো লাগে। আবার খারাপ খেললেও কিছু না। বড়জোর পরের টেস্টে দল থেকে বাদ পড়বেন। তাতে কি আর এসে গেল। তিনি তো সেই বাজে, পচে যাওয়া ফরম্যাটটাই খেলেন। তাঁকে নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে? রাহানে বা পূজারা সমগোত্রীয় হওয়া সত্ত্বেও খেলার পাতায় বা টিভির স্ক্রিনে তাঁর থেকে বেশি জায়গা পান। কারণ, ঋদ্ধিমান ব্যাটসম্যান নন। ঋদ্ধিমান বক্স অফিস নন।
বিরাট কোহলি কোনো এক সময় বলেছিলেন যে ঋষাভ পান্থ যত বড় ব্যাটসম্যানই হন না কেন, টিম ম্যানেজমেন্টের উইকেটরক্ষক হিসেবে প্রথম পছন্দ ঋদ্ধিমান। অথচ সেই কোহলি নিউজিল্যান্ডের মতো জায়গায়, যেখানে বল মুহুর্মুহু সুইং করে এবং উইকেটরক্ষকের দক্ষতা এবং অদক্ষতা যেখানে চোখে আঙুল দিয়ে প্রকাশ পায়, সেখানে ঋদ্ধি নন, দুটো টেস্টই খেললেন কোনো এক পান্থ।
ক্রাইস্টচার্চে প্রথম ইনিংসে তিনি বাই দিয়েছেন ২০ রান। যার মধ্যে বড়জোর ৬ রান সত্যই ধরা অসম্ভব। বাকি ১৪ রান? না কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না। পান্থ কত বড় ব্যাটসম্যান! এক দুটো ম্যাচে বাজে কিপিংয়ে দলকে ডুবিয়েছে তো কি হয়েছে, ব্যাটিংয়ে জেতাবে। আর প্রথম ইনিংসে ওই কুৎসিত আউট? অরে ও তো ওভাবেই খেলে। যেদিন চলবে, একা হাতে ম্যাচের রং পাল্টে দেবে। অথচ এই নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেই সাড়ে তিন বছর আগে, ইডেনে একই রকম কঠিন উইকেটে ঋদ্ধিমানের দু ইনিংসের ব্যাটিং কবে ধুলো পড়া সরকারি ফাইলের মতো হারিয়ে গেছে। কারণ ঋদ্ধিমান বক্স অফিস নন।
তাঁর কোনো হাইপ্রোফাইল প্রেম নেই। পার্টিতেও বেশি দেখা যায় না। সোশ্যাল মিডিয়া তেও একেবারেই ঘন ঘন পোস্ট করেন না। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন। আজকাল বহুচৰ্হিত সেলিব্রিটি হতে গেলে যে যে গুণগুলো লাগে কোনোটাই তাঁর মধ্যে নেই। তিনি শুধু জানেন কিপিং করতে এবং চলনসই ব্যাটিং। যতই কট্টর ক্রিকেটপ্রেমী বলুন যে প্রবীর সেন এর সমগোত্রীয় কিপার তিনি, কেই বা শুনছে? সোশ্যাল মিডিয়া তে কি প্রচার পাচ্ছে? পাচ্ছে না। কারণ ঋদ্ধি বক্সঅফিস নন।
সত্তর আশির দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বা স্টিভ ওয়াহ’র অস্ট্রেলিয়া। এই দুটো টিমের মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবে কোনো মিল নেই। একদল ক্যালিপসোর রোমান্স এবং কেয়ার ফ্রি ক্রিকেটের পতাকাবাহক। আরেকদল নিষ্ঠুর পেশাদারি ক্রিকেটের। অথচ এই দুই দল একটি জায়গায় গিয়ে একেবারে এক। প্রথম একাদশ। চোট আঘাত বা সাসপেনশন ছাড়া খুব একটা বদল হয়নি।
আশির দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম একাদশ তো আমাদের বাবা কাকারা এখনও এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলতে পারেন। আমরা অস্ট্রেলিয়ার একাদশ। শাস্ত্রীয় বচন অনুযায়ী কোহলির ভারত এই দুই টিমের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। অথচ এত বেশি প্রথম একাদশে বদল? এ তো সেই অবনমন আতঙ্কিত ফুটবল ক্লাব। ঘন ঘন প্রথম একাদশ বদলায়।
প্রথম ম্যাচে অশ্বিন তিন উইকেট নিলেন, অথচ দ্বিতীয় টেস্টে বাদ। একবার ৬ ব্যাটসম্যান নীতি, আবার পরক্ষণেই ৫ বোলার। বিশ্বসেরা টেস্ট টিমের কাছে আমরা কি এটুকু স্থায়িত্ব আশা করতে পারি না ? দেশের মাটিতে ঋদ্ধি কিপার, আবার বিদেশ সফরে এলেই ভুলে যাওয়া হবে তাঁকে, দলে এসে যাবেন পান্থ। আশির দশকের ওয়েস্টইন্ডিজ কিন্তু কোনো ব্যাটসম্যান কিপার নিয়ে প্রায় কুড়ি বছর মস্তানি করেনি, ডেরিক মারে বা ডুজন দলে এসেছিলেন শুধুমাত্র তাঁদের উৎকৃষ্ট কিপিংয়ের জন্য।
টেস্ট ক্রিকেট কি এমন বদলে গেল যে কিপার কে আগে ভালো ব্যাটসম্যান হতে হবে? এতো ফুটবলে গোলকিপার কে বলা, তুমি প্রয়োজনে উঠে খেলতে পারবে তো? পায়ে ভালো ফ্রি-কিক আছে? তাহলেই কিন্তু তোমায় দলে বিবেচনা করা হবে। গোল বাঁচানোটা গৌন স্কিল। এক রকম থাকলেই হবে।
১৯৯০ সালে কিরণ মোরে ৩৬ রানে গ্রাহাম গুচের সহজ ক্যাচ ফেলেন। গুচ করেন ৩৩৩। ভালো উইকেটরক্ষকের গুরুত্ব তারপরেও ভারতীয় ক্রিকেটে আলোচিত বিষয় নয়। তাই এখনও পান্থ শুধুমাত্র ঋদ্ধির চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান হওয়াতে দলে আসেন। কিন্তু কে বোঝাবে কোহলি-শাস্ত্রী কে? আসলে ঋদ্ধি তো বক্স অফিস নন।