দুষ্টু-মিষ্টি পিল

কিন্তু, পিল সাহেবের নেশা যে তখনও কাটেনি। তিনি বুঝতেই পারেননি, এসব কি ঘটছে। তাঁর অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্টোডিয়ার্ড হয়তো বুঝেছিলেন, এবং তিনি জোর করে পিল কে শাওয়ার নিতে পাঠান। ঠাণ্ডা জলের ধাক্কায় নেশা কাটতেই, পুরো ব্যাপারটা তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি স্টোডিয়ার্ড কে বললেন, ‘দাও তো দেখি আমায় বলটা, ব্যাটাচ্ছেলে অজিগুলোকে দেখে নিচ্ছি।’

ফলো অন খাবার পর টেস্ট ম্যাচ জয়ের সংখ্যা টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে সাকুল্যে তিন। ১৪৪ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট থাকবে কিনা জানা নেই। সেটা থাকার ক্ষীণতম সম্ভাবনা থাকলেও, এই ৩ সংখ্যাটা বাড়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এবং তার জন্য দায়ী এই ধরণেরই একটি টেস্ট ম্যাচ, যার ২০ বছর পূর্ণ হবে আর কয়েকদিন পর।

লক্ষণ-দ্রাবিড়ের সেই অমর বীরগাথা পরের প্রজন্মের অধিনায়কদের এমনই মনোরোগী করে দিয়েছে যে, তাঁরা হয়তো ভারতের ঘূর্ণি পিচে টেস্ট ম্যাচে টস জিতে বোলিং নিয়ে নেবেন, ক্লিন্তু ৪০০ রানের লিড না হলে ফলো অন করাবেন না। তা, ১৯৮১ সালের হেডিংলি এবং তার নায়ক বোথাম ও উইলিস, এবং ২০০১ এর ইডেন-ফলো-অন খেয়ে টেস্ট জেতার জন্য বিখ্যাত এই দুই ম্যাচ নিয়ে এতো কথা হয়। কিন্তু এই ধরণের প্রথম ম্যাচটি এখন বিস্মৃতপ্রায়। এবং তার সঙ্গে এই ম্যাচের নায়করাও। আলবার্ট ওয়ার্ড ও ববি পিল। অবশ্য সেটা আশ্চর্য্যের না।

ম্যাচটির বয়স ১২৬ বছর। সেই ১৮৯৪ সালে সিডনিতে হয়ে যাওয়া ম্যাচ আর কেই বা মনে রাখে? তা এই ম্যাচের ব্যাটিং নায়ক ওয়ার্ডকে নিয়ে নাহয় পরে কোনোদিন কথা বলা যাবে। পিলের জন্মদিনে সেই ম্যাচের বোলিং নায়কের স্মৃতিচারণাই করি।

ভারতের যেমন ছিল স্পিন চতুর্ভূজ, ইয়র্কশায়ারেরও সেরকম বাঁহাতি স্পিন চতুর্ভূজ ছিল। ভারতের স্পিন চতুর্ভুজের সাথে তার অবশ্য তফাৎ রয়েছে। প্রসন্ন, বেদি, বেঙ্কট এবং চন্দ্রশেখর-এই চারজন মোটামুটি একই সময়ে স্পিন গ্রহে অবতরণ করেন। কিন্তু ইয়র্কশায়ারের এই স্পিন চতুর্ভুজের ক্যারিয়ার অল্পসল্প ওভারল্যাপ করলেও, তা নিতান্তই নগন্য।

একেক প্রজন্ম পেয়েছে একেকজন স্পিন মহীরুহকে। এই স্পিন চতুর্ভূজ হলেন যথাক্রমে এডমন্ড পিট্ (১৮৭৯-১৮৯০), আমাদের গল্পের নায়ক ববি পিল (১৮৮২-১৮৯৭), উইলফ্রেড রোডস (১৮৯৮-১৯৩০) এবং ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা স্পিনার হেডলি ভেরিটি (১৯৩০-৩৯) । ১০০ উইকেট যদি মাপকাঠি হয়, তাহলে ববি পিলের চেয়ে ভালো বোলিং গড় মাত্র দুইজনের। জর্জ লোমান এবং সিড বার্নেস। ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৬-এই ১২ বছরে ববি পিল ২০ টি টেস্ট খেলেছেন এবং সবকয়টি অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।

পুরোনো লেখা পড়ে মনে হয়, খানিকটা আমাদের জাদেজার মতো বোলার ছিলেন পিল। নিখুঁত লাইন-লেংথ এবং অল্পসল্প টার্ন, এই ছিলো তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। জাদেজার মতো মারকুটে বাঁহাতি ব্যাটিং এবং কভার অঞ্চলে ক্ষিপ্র ফিল্ডিংও করতেন পিল। তবে জাদেজা নিজের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য যে পরিমান পরিশ্রম করেন, পিল তার অর্ধেকও করতেন বলে মনে হয় না। এমনকি সমসাময়িক ক্রিকেটের হিসেবেও তাঁর জীবনযাপন ছিল বেয়ারা ও বেহিসেবি। এর খেসারত অবশ্য তাঁকে ভালোমতোই দিতে হয়। কিন্তু সেকথায় পরে আসছি।

আগে আসি সেই অনবদ্য ১৮৯৪ টেস্টের গল্পে। সিডনির উইকেট বরাবরই ব্যাটিং সহায়ক, এবং প্রথম দুদিন অস্ট্রেলিয়া সেই পিচ এবং রোদ ঝলমলে দিনগুলোর কল্যানে এবং অবশ্যই সিডি গ্রেগোরির অনবদ্য ২০০র সৌজন্যে ৫৮৬ রানের পাহাড় চাপিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের ওপর। প্রথম ইনিংসে আলবার্ট ওয়ার্ড ছাড়া কেউ সেরকম দাঁড়াতে পারেননি। ইংল্যান্ড করে ৩২৫।

ফলস্বরূপ ইংল্যান্ডকে আবার ব্যাট হাতে নামতে হলো এবং আবারো ত্রাতার ভূমিকায় সেই ওয়ার্ড। তাঁর সেঞ্চুরিতে ভর করে ইংল্যান্ড করে ৪৩৭ এবং অস্ট্রেলিয়ার জন্য লক্ষমাত্রা দাঁড়ায় ১৭৭। খেলার শেষদিন যখন শুরু হবে অস্ট্রেলিয়া তখন ১১৩ রানে ২ উইকেট। হারা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সেই দুঃখেই কিনা কে জানে, পিল একটু বেশিই মদ্যপান করে ফেলেন সেদিন।

অনেকে বলেন, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ নাকি পাশবালিশের বদলে ব্ল্যাকলেবেলের বোতল নিয়ে শুতেন। পিলও কি তাই করতেন? তা, পেটে পানিটা একটু বেশি পড়ায়, সারারাত যে বৃষ্টি পড়েছে, সেটা পিল বুঝতেই পারেননি। পরেরদিন সকালের রোদ ঝলমলে দিন দেখে ভেবে নিয়েছেন বুঝি আর আশা নেই। তৎকালীন ক্রিকেটে যেহেতু পিচ ঢাকা দেবার রেয়াজ ছিলোনা, তাই বৃষ্টি বাদ্লায়, স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাওয়া পিচ স্পিন বোলারদের পক্ষে দারুণ সুবিধাজনক হয়ে উঠতো।

কিন্তু, পিল সাহেবের নেশা যে তখনও কাটেনি। তিনি বুঝতেই পারেননি, এসব কি ঘটছে। তাঁর অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্টোডিয়ার্ড হয়তো বুঝেছিলেন এবং তিনি জোর করে পিল কে শাওয়ার নিতে পাঠান। ঠাণ্ডা জলের ধাক্কায় নেশা কাটতেই, পুরো ব্যাপারটা তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি স্টোডিয়ার্ড কে বললেন, ‘দাও তো দেখি আমায় বলটা, ব্যাটাচ্ছেলে অজিগুলোকে দেখে নিচ্ছি।’

তা তিনি দেখলেন, ১১৩ রানে ২ উইকেট থেকে অস্ট্রেলিয়া শেষ হয়ে যায় ১৬৬ রানে। পিল নেন ৬৭ রানে ৬ উইকেট। ১০ রানে ম্যাচ জিতে নেয় ইংল্যান্ড। ফলো-অন খেয়েও টেস্ট ম্যাচ জেতারপরবর্তী নজির গড়তে লেগে যায় আরো ৮৭ বছর।

এই কাহিনীর ৩ বছর পর, শেফিল্ডের ব্রাম্যাল লেনে ল্যাঙ্কাশায়ার এর বিরুদ্ধে ম্যাচ চলাকালীন মদ্যপ অবস্থায় ববি পিল পিচের ওপর মূত্রত্যাগ করেন। ইয়র্কশায়ার অধিনায়ক লর্ড হক পিলকে মাঠ থেকে বার করে দেন। এরপর আর কোনোদিন ইয়র্কশায়ার তো দূর, প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটই খেলা হয়নি ববি পিলের। প্রাচীন পন্থীরা কি তাহলে শুধু-শুধুই বলেন, আজকালকার ছেলেগুলোকে দেখো, ভদ্রলোকের খেলার কি হাল করেছে? দেখা যাচ্ছে, তৎকালীন যুগেও ববি পিলের মতো ‘দুষ্টু’ ক্রিকেটার ছিলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...