‘আমি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি’

ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছেন জানিয়ে রোনালদো দাবি করেন তাঁর সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। তিনি আসার আগে থেকেই মাঠ এবং মাঠের বাইরে ইউনাইটেড ধুঁকছিল। তিনি আসার পর সমস্ত দোষ তাঁর কাঁধে চাপিয়ে যেন নিস্তার পেতে চাইছে ক্লাব কর্তারা। এছাড়া দুই কোচ রালফ রাগনিক এবং এরিক টেন হাগের বিপক্ষেও ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। 

জুভেন্টাস ছেড়ে নিজের পুরনো ক্লাব ম্যানচেস্টারে আসার পর থেকেই সময়টা ভাল কাটছে না ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। এই মৌসুমে তো শুরুর একাদশেও জায়গা পাচ্ছেন না। বুঝা যাচ্ছিল কোথাও যেন কেটে গিয়েছে পুরনো সুরটা। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে কোচ এরিক টেন হাগের বিপক্ষে রীতিমতো বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন এই তারকা। 

৩৭ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা। ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার পাশাপাশি পাঁচবার জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অধীনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডেই কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোঁটা রোনালদোর। আর সেই ওল্ড ট্রাফোর্ডেই কিনা যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না তিনি। কাতারে নিজের পঞ্চম এবং সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাবার আগে রোনালদো তাই কথা বলেছেন খোলামেলাভাবেই। টক টিভির পিয়ার্স মরগ্যানকে দেওয়া দেড় ঘণ্টার সাক্ষাৎকারে রোনালদোর প্রতিটা কথাই যেন একেকটা বোমা। 

ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছেন জানিয়ে রোনালদো দাবি করেন তাঁর সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। রোনালদো বলেন, ‘ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাকে কালো ভেড়া বানানো হয়েছে। আমি এরিক টেন হ্যাগকে সম্মান করি না। শুধু কোচই নয়, ক্লাবের আশেপাশের অন্য দু-তিনজন লোক ও যুক্ত। আমি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি।’

রোনালদো মনে করেন, তিনি আসার আগে থেকেই মাঠ এবং মাঠের বাইরে ইউনাইটেড ধুঁকছিল। তিনি আসার পর সমস্ত দোষ তাঁর কাঁধে চাপিয়ে যেন নিস্তার পেতে চাইছে ক্লাব কর্তারা। এছাড়া দুই কোচ রালফ রাগনিক এবং এরিক টেন হাগের বিপক্ষেও ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। 

রাগনিক প্রায় এক দশক কোনো দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন না, বরং স্পোর্টিং ডিরেক্টর হিসেবেই ছিলেন বেশি সফল। সেই দিকে ইঙ্গিত করে রোনালদো বলেন, ‘আপনি যদি কোচই না হন, তাহলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত দল সামলাবেন কি করে? আমি তো এর আগে তাঁর নামই শুনিনি কখনো।’

তবে রোনালদোর সবচেয়ে বড় ক্ষোভ বর্তমান কোচ এরিক টেন হাগকে নিয়ে। আয়াক্স থেকে এই মৌসুমেই ইউনাইটেডের দায়িত্ব নেয়া টেন হাগ রোনালদোকে সাসপেন্ড করেছিলেন টটেনহ্যামের বিপক্ষে শেষ মিনিটে মাঠ নামতে অস্বীকৃতি জানানোয়। রোনালদো বলেন, ‘তাঁর প্রতি আমার কোনো সম্মান নেই কারণ সে আমাকে সম্মান করে না। কারও যদি আমার প্রতি সম্মান না থাকে, তাহলে আমিও তাঁকে সম্মান করবো না।’

কয়েক মাস আগে রোনালদোর সাবেক ইউনাইটেড সতীর্থ ওয়েন রুনিও বিদ্রুপাত্নক মন্তব্য করেন রোনালদোকে নিয়ে। এতদিন চুপ থাকলেও দিন সেই জবাবও দেন এই তারকা। বলেন, ‘আমি জানি না সে কেন আমার সমালোচনা করেছিল। হয়তো তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে আর আমি এখনো খেলছি সে কারণেই।’ পরমূহুর্তেই ফোড়ন কাটেন, ‘আমি বলবো না আমি তাঁর চেয়ে দেখতে সুন্দর। তবে এটা সত্য।’

মাঠের বাইরেও কঠিন সময় পার করছেন এই তারকা। এই বছরের এপ্রিলেই নিজের সদ্যোজ্যাত ছেলেকে হারান রোনালদো-জর্জিনা দম্পতি। বেদনার সেই সময়টাতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুল সমর্থকদের থেকে সান্ত্বনা পেলেও পাশে দেখা যায়নি ইউনাইটেডের কর্মকর্তা, কোচ, খেলোয়াড় কিংবা সমর্থকদের। এছাড়া জুলাইতে তাঁর তিন মাসের কন্যা হাসপাতালে ভর্তি থাকায় সময় মত প্রি সিজনে দলের সাথে যোগ দিতে পারেননি। সেই ব্যাপারটাও ভালোভাবে মেনে নেয়নি ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। 

অথচ গল্পের শেষটা আরও সুন্দর হতে পারত। মাত্র ১৪ মাস আগে চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে পুনরাবর্তন ঘটেছিল তাঁর। অথচ সেই ট্রান্সফার মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটি থেকে বেশি বেতনে অফার ছিল তাঁর কাছে। কিন্তু অ্যালেক্স ফার্গুসনের প্রতি আনুগত্য আর ইউনাইটেডের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন তিনি।

ইউনাইটেডে ফিরে আসার পর প্রথম ম্যাচেই নিউক্যাসলের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছিলেন তিনি। সেই ম্যাচে সমর্থকরাও উৎসাহ দিয়েছিলেন ম্যাচজুড়েই, ‘ভিভা রোনালদো’ স্লোগানে মাতিয়ে রেখেছিলেন গ্যালারি। তাঁর সতীর্থ মার্কাস রাশফোর্ড বলেছিলেন, ‘মনেই হচ্ছে সে কখনও আমাদের ছেড়ে গিয়েছিল।’

কিন্তু মধুচন্দ্রিমা কেটে যেতে সময় লাগেনি। ক্লাবে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হওয়ায় খানিকটা হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। রোনালদো বলেন, ‘ক্লাবে কোনো উন্নতি হয়নি। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবসর নেবার পর ক্লাব একটুও সামনে এগোয়নি। কিছুই বদলায়নি।’

এছাড়া তরুণ খেলোয়াড়দের খেলার চাইতে মাঠের বাইরের জীবন নিয়ে বেশি আগ্রহ থাকায় অবাক হন তিনি। মোদ্দাকথা, বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরেও দলে খেলোয়াড় টানায় মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেনি ইউনাইটেড, বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের বদলে গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় ভেড়ানোতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে তাঁরা। 

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সমর্থকদের সত্যিটা জানা উচিত। আমি সব সময় ক্লাবের ভাল চাই। আর সেই কারণেই ক্লাবে ফিরে এসেছি। কিন্তু আমাদের ক্লাবের অভ্যন্তরে কিছু বিষয় রয়েছে যেসব কারণে ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের থেকে পিছিয়ে গিয়েছি আমরা। ইউনাইটেডের মত ক্লাবের সেরা তিনে থাকা উচিত। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না।’

আরও বলেন, ‘পিকাসো একবার বলেছিলেন কিছু গড়তে হলে আগে ধ্বংস করতে হবে। আর সেই ধবংসের শুরুটা যদি তাঁরা আমাকে দিয়েই শুরু করে, তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ভালোবাসি, সমর্থকদের ভালোবাসি। সেরাদের কাতারে আবারও উঠতে আমাদের অনেক কিছু বদলাতে হবে।’

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় বিশ্বসেরা সব দলে কাটিয়েছেন রোনালদো। শীর্ষস্থান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাবনা স্থান পায়নি তাঁর কাছে। গত মৌসুমেও একাই টেনেছেন দলকে, ২৪ গোল করে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। কিন্তু এই মৌসুমে দলে জায়গা হারিয়েছেন, বেঞ্চে বসেছেন এমনকি সাসপেন্ডেড হয়েছেন।

এসবের ভিড়ে, রোনালদো হয়তো মানছেন যে, রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়াটা তাঁর জন্য খুবই বাজে সিদ্ধান্ত ছিল। সব মিলিয়ে বলাই বাহুল্য ইউনাইটেডে নিজের দ্বিতীয় অধ্যায়টা ভাল যাচ্ছে না রোনালদোর। জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোতেই হয়তো ক্লাব ছাড়বেন। সব মিলিয়ে তিক্ততার মধ্য দিয়েই ইউনাইটেড ক্যারিয়ারের ইতি টানতে যাচ্ছেন এই তারকা।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...