শারজাহ মঞ্চে ইংরেজ বিক্রম

একটিও ম্যাচ ইংল্যান্ড সেই সিরিজে আরামে জেতেনি। প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিরুদ্ধে মাত্র ৭ রানে জয়। তাও ২৫০ করার পর। সেসময় শারজাহর পিচে ২৫০ ভালো স্কোর বলেই গণ্য হতো। শচীন টেন্ডুলকারকে মোক্ষম সময়ে ৯১ রানে আউট করে ভারতকে হারিয়ে দেন ম্যাথিউ ফ্লেমিং। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও জয় মাত্র ৮ রানে। এবার মাত্র ২১৫ হাতে নিয়ে। ফাইনালেও শেষ দশ ওভারে প্রায় আশির কাছাকাছি তাড়া করে জেতা। তাও ৬ উইকেট খোয়ানোর পর। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার, এরপর আর হোলিওক মাত্র ১০ টি ওয়ানডেতে অধিনায়ক হিসাবে সুযোগ পান।

নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ড দলটি বড়ো অদ্ভুত। এতো সব তারকা খেলোয়াড়। মাইক আথারটন, নাসির হুসেইন, গ্রাহাম থর্প, গ্রায়েম হিক, ড্যারেন গফ – একটা লম্বা সময় ধরে মাইক গ্যাটিং ও গ্রাহাম গুচ। কিন্তু খুব খুঁটিয়ে যদি সেই দশকে তাদের ফলাফলের হিসাব করা যায়, তবে দেখা যাবে প্রায় ফক্কা। এবং শুধু ফক্কা তা নয়, এমন এমন দিন সেসময়ের ইংরেজ সমর্থকরা সেসময় প্রতক্ষ্য করেছেন, সময়টা ২০১৯ হলে সমাজ মাধ্যমে ছিছিক্কার পরে যেত।

সে ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ৪৬ অল আউট হোক, বা গোটা দশকে একটিও অ্যাশেজ সিরিজ জিততে না পারাই হোক, বা ভারতে এসে চুনকাম হওয়াই হোক। মাঝে খান দুয়েক সিরিজ বা টেস্ট ম্যাচ জেতা। অদ্ভুত সব টেস্ট ম্যাচ। ওভাল ১৯৯৭ বনাম অস্ট্রেলিয়া মনে করুন। টাফনেল, সেই টাফনেল যাঁর সম্পর্কে একবার ইয়ান চ্যাপেল বলেন, ‘টাফনেল বল করলে ইংল্যান্ডের একটা সুবিধা হলো, ও ফিল্ডিং করছে না।’

তিনি এক হাতে অস্ট্রেলিয়াকে চতুর্থ ইনিংসে রুখে দিলেন। বা ১৯৯৪ এর ক্যারিবিয়ান সফরে ফ্রেজারের অনবদ্য বোলিংয়ে (ইনিংসে ৮ উইকেট ) ইংল্যান্ডের জয়। বা ১৯৯৫ সালে আথারটনের ম্যাচ বাঁচানো জোবার্গ ম্যারাথন। মানে টেস্ট ম্যাচে তবুও বলার মতো একটু আধটু কিছু ছিল। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে হারের পর হার। তার একটা প্রধান কারণ অবশ্য তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডের সাহসি সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার অভাব। ব্যাপারটা একটু খুলে বলি।

১৯৯২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ফাইনাল খেলার পর, গোটা দশকে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালের মুখ দেখেনি। আসলে ১৯৯২ বিশ্বকাপের পর একদিনের খেলাটা এতটাই বদলে যায়, যে ইংল্যান্ড সেই বদলের সাথে একেবারেই তাল মেলাতে পারেনি। সেসময় শারজাহয় চুটিয়ে ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা হতো। কিন্তু ইংল্যান্ডের শারজা সফরের সংখ্যা মাত্র ২, ম্যাচের সংখ্যা ৮। তাও দুটি সফরই একেবারে দশকের শেষ দিকে।

উপমহাদেশের দলগুলোর কথা বাদ দিলাম। কিন্তু ইংল্যান্ডের সমগোত্রীয় দলগুলো এতবার শারজাহতে খেলে গেছে। অস্ট্রেলিয়া দশকে ১২ টি ম্যাচ ও তিনটি সফর, নিউজিল্যান্ড ১৫ টি ম্যাচ ও চারটি সফর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২২ টি ম্যাচ ও পাঁচটি সফর। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডের গোঁড়ামি নাকি দূরদর্শিতার অভাব, কোনটি এর প্রধান কারণ তা জানা নেই। জয়াসুরিয়া, গ্রেটব্যাচ, শচীন-সিধুরা ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম পনেরো ওভারের সংজ্ঞা বদলে দেবার পরেও, ইংল্যান্ড সেসময় কুড়ি বছর আগের টেমপ্লেটে ওয়ানডে খেলতো।

এমনকি রঙিন পোশাকে ওয়ানডে খেলা যখন প্রায় জলভাত, তখনও ইংল্যান্ড আটকে ছিল সাদা পোশাকের মায়াজালে। সেই ১৯৯৮ সালে গিয়ে তারা রঙিন পোশাকে নিজেদের দেশে একটি ওয়ানডে সিরিজ খেলে। বাইরে গেলে অবশ্য রঙিন পোশাক পরেই খেলতে হতো। কিন্তু এর মধ্যেও একটি ওয়ানডে সিরিজ ইংল্যান্ড জেতে। এবং অভাবনীয় ভাবে। আজ হঠাৎ সেই সিরিজটা নিয়ে লেখার কথা মাথায় এলো।

সালটা ১৯৯৭। ইংল্যান্ডের প্রথম শারজা সফর। কি জানি, হয়তো শারজায় দ্বিতীয় শ্রেণীর ওয়ানডে টুর্নামেন্ট বলেই কিনা, মূল দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই সেই সফর করেননি। অধিনায়ক হয়ে গেছিলেন অ্যাডাম হোলিওক। সম্ভবত সেটাই ইংল্যান্ডের শাপে বর হয়ে দেখা দেয়। চতুর্দলীয় টুর্নামেন্টে বাকি তিনটি দল ছিল ভারত, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইংল্যান্ড সেবার অ্যালেক স্টুয়ার্টকে দিয়ে কিপিং ও ওপেনিং করায়। তাঁর সাথে ওপেনে যেতেন অ্যালিস্টার ব্রাউন। এই এলিস্টার ব্রাউন সারের হয়ে ঠিক সেই কাজটাই করতেন, যেটা সনাথ জয়াসুরিয়া শ্রীলঙ্কার হয়ে করতেন।

মিডল অর্ডারে নিক নাইট, গ্রায়েম হিকের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটার। এরপর মাঝের ওভারে ধরার জন্যে ছিলেন থর্প। এবং একঝাঁক অলরাউন্ডার। যাঁদের সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার ‘বিটস অ্যান্ড পিসেস’ ক্রিকেটার বলে থাকেন। কেউ দারুন বোলার বা ব্যাটার নন। কিন্তু দুটো কাজই চালিয়ে দিতে পারেন। যেমন হোলিওক নিজে, মার্ক ইল্যাম, জেমস বন্ড স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ভাইপো ম্যাথু ফ্লেমিং, স্পিনার রবার্ট ক্রফট।

পেস বোলার হিসাবে ছিলেন হেডলি ও পরে স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলা ডগি ব্রাউন। শারজার ধীরগতি ও হাঁটু সমান বাউন্সের উইকেটে, গতির হেরফের ঘটানো এবং উইকেট টু উইকেট বোলিং করা এইসব বোলাররা ইংল্যান্ডের সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক যেমন ’৯২ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের ডিবলি-ডবলিরা দলের সম্পদ হয়ে দেখা দেন। ক্রিস হ্যারিস, উইলি ওয়াটসন ইত্যাদি। হোলিওকের সেই ইংল্যান্ড সেবার শুধু ভালো ব্যাটিং বা বোলিংয়ের জোরেই টুর্নামেন্টে অপরাজিত থেকে সিরিজ জেতেনি। কঠিন সময়ে, কঠিন ম্যাচ বার করতে পারার ক্ষমতাও সেই দলের ছিল।

একটিও ম্যাচ ইংল্যান্ড সেই সিরিজে আরামে জেতেনি। প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিরুদ্ধে মাত্র ৭ রানে জয়। তাও ২৫০ করার পর। সেসময় শারজাহর পিচে ২৫০ ভালো স্কোর বলেই গণ্য হতো। শচীন টেন্ডুলকারকে মোক্ষম সময়ে ৯১ রানে আউট করে ভারতকে হারিয়ে দেন ম্যাথিউ ফ্লেমিং। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও জয় মাত্র ৮ রানে। এবার মাত্র ২১৫ হাতে নিয়ে। ফাইনালেও শেষ দশ ওভারে প্রায় আশির কাছাকাছি তাড়া করে জেতা। তাও ৬ উইকেট খোয়ানোর পর। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার, এরপর আর হোলিওক মাত্র ১০ টি ওয়ানডেতে অধিনায়ক হিসাবে সুযোগ পান।

১৯৯৮ এর ক্যারিবিয়ান সফর, ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম রঙিন পোশাকে হওয়া এমিরেটস ট্রাই সিরিজ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। প্রথম সিরিজটিতে ৪-১ হেরে যায় ইংল্যান্ড, দ্বিতীয়টিতে ফাইনালে ওঠে (দক্ষিণ আফ্রিকাকে টপকে), তৃতীয়টিতে ওই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেই হেরে যায়। একেবারে পাতে দেওয়া যায়না এমন পারফরম্যান্স কি? মনে তো হয় না। কিন্তু ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) হোলিওককে ভরসা করতে পারেনি।

আথারটন, হুসেইনদের বাদ দিয়ে দল নামাতে ভয় পেয়েছে। বর্তমানে অ্যান্ডারসন, ব্রড, কুক, বেলদের বাদ দিয়ে আনকোরা একদিনের দল নামানো এবং তাতে ভরসা রাখার সাহস দেখিয়েছে তারা। এবং তার সুফলও পেয়েছে হাতে নাতে। সেসময় যদি ওই শারজা কাপ জেতা দলটার ওপর আরেকটু ভরসা রাখতে পারতো ইংল্যান্ড বোর্ড, কে জানে ইংল্যান্ডকে নিজেদের খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে ২০১৯ অবধি অপেক্ষা করতে হতো না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...