ছক্কা-হ্যাটট্রিক-সেঞ্চুরি-অন্যান্য

৫৬ রানের তাড়া করতে নেমে দ্রুতই দুই উইকেট পড়ে যায় ভারতের, স্কোরবোর্ডে তখন মাত্র ৬৫ রান। ঠিক সে সময় টিম ম্যানেজমেন্ট ক্রিজে পাঠায় চেতন শর্মাকে। তখন পর্যন্ত চেতন শর্মা ওয়ানডেতে একটা ফিফটি অবধি করেননি, বাজি ধরাটা তাই সহজ ছিল না ভারতের জন্য। তবে বাজির ঘোড়া হিসেবে চেতন কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টকে আশাহত করেননি। মাত্র ৯৬ বলে ১০১ রান করে তিনি ভারতকে ম্যাচ জিতিয়ে দেন ম্যাচ শেষের ১১ বল আগেই।

চেতন শর্মাকে আপনি কেন মনে রাখবেন?

এই প্রশ্নটা যদি আপনাকে আমি করি, আপনি উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেতে পারেন। চেতন শর্মা তো তাঁকে মনে রাখার একটা মাত্র উপলক্ষ্য তৈরি করেননি। ভারতীয় কোন খেলোয়াড়ের প্রথম হ্যাটট্রিকের কীর্তিটা তাঁর, স্রেফ বোলার হয়েও চারে নেমে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ইংল্যান্ডের সাথে সিরিজ জয়ের কীর্তি আছে; চেতন শর্মাকে মনে রাখার মত ঘটনার অভাব নেই।

কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস! সারা দুনিয়া চেতন শর্মাকে মনে রেখেছে এক ছক্কার জন্য। অস্ট্রাল-এশিয়া কাপের ফাইনালে এই শর্মাকে ছক্কা মেরে পাকিস্তানকে ট্রফি জিতিয়েছিলেন বড়ে মিয়া খ্যাত জাভেদ মিয়াঁদাদ।

চেতন শর্মার জন্ম হয়েছিল জানুয়ারির তিন তারিখে, ১৯৬৬ সালে। লুধিয়ানার সেই কিশোরের ক্রিকেটের প্রতি প্রেম জেগে উঠেছিল অনেক অল্প বয়েসে। তা সেই প্রেমের প্রতি সুবিচারের জন্যে যথার্থ গুরুও তিনি পেয়েছিলেন। বলছি দেশ প্রেম আজাদের কথা; যার হাতে ক্রিকেটের দীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং কপিল দেব।

দেশ প্রেমের আজাদের দীক্ষা যে বিফলে যায়নি, চেতন তা প্রমাণ করেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে। ১৯৮০ সালে নর্থ জোনের অনূর্ধ্ব-১৫ দলে ডাক পেয়ে তিনি রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এরপরের দুই বছর তিনি খেলেছেন নানা বয়সভিত্তিক দলে।

এরপর ১৯৮২ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও অভিষেক ঘটে চেতনের। হরিয়ানার হয়ে রঞ্জি ট্রফির সেই মৌসুমটাতে তিনি ছয় ম্যাচ খেলেই চেতন নিয়েছিলেন ২৭ উইকেট। প্রথম মৌসুমের এই পারফর্ম্যান্সের পর তিনি ডাক পেয়েছিলেন দ্বিতীয় মৌসুমেও, সেখানেও উজ্জ্বল চেতন শর্মা। মাত্র নয় ম্যাচ খেলেই নিয়েছিলেন ৫১ উইকেট।

ভারতের সবচাইতে মর্যাদাপূর্ণ এই আসরে এমন উজ্জ্বল পারফর্ম্যান্সের পুরস্কার পেয়েছিলেন চেতন শর্মা। ১৯৮৩ সালেই জামশেদপুরে চেতন শর্মার মাথায় ওঠে ভারতীয় ওয়ানডে অভিষেকের টুপি। ওয়ানডেতে সেই ম্যাচে ৬০ রানে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে হয়ত নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি।

তবে পরের সিরিজে পাকিস্তানের সাথে টেস্ট ম্যাচে ডাক পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে লাহোরে সেই টেস্ট থেকেই যে শুরু, ধীরে ধীরে চেতন শর্মা হয়ে উঠলেন ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য।

১৯৮৬ সালেই অবশ্য সেই দু:স্বপ্নের মুখোমুখি হন শর্মা।

শারজায় বসেছিল অস্ট্রাল-এশিয়া কাপের আসর। ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। গাভাস্কারের ৯২ ও শ্রীকান্তের ৭৫ রানে ভর করে আগে ব্যাট করা ভারত ২৪৫ রান তুলেছিল। জবাবে পাকিস্তানের হয়ে একা রুখে দাড়ান মিয়াদাদ। শেষ বলে দরকার ছিল চার রান। আর চেতনকে মিয়াদাঁদ ছক্কাই মেরে দেন।

পরের বছরই এই চেতন শর্মা ভারতকে বিরাট এক আনন্দ উপলক্ষ এনে দেন। আগের বিশ্বকাপ জেতা ভারতের হয়ে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। তাও আবার বিশ্বকাপে। নিউজিল্যান্ডের তিন ব্যাটসম্যানকেই বোল্ড করে ফেরান তিনি।

চেতনকে এরপরও বড় কিছু পেতে অনেক লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবে সেই অপেক্ষাও ফুরায় যখন নেহেরু কাপে ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচটা মাঠে গড়ায়। সফরকারীরা সে ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে তোলে ২৫৫ রান। ২৫৬ রানের তাড়া করতে নেমে দ্রুতই দুই উইকেট পড়ে যায় ভারতের, স্কোরবোর্ডে তখন মাত্র ৬৫ রান। ঠিক সে সময় টিম ম্যানেজমেন্ট ক্রিজে পাঠায় চেতন শর্মাকে।

তখন পর্যন্ত চেতন শর্মা ওয়ানডেতে একটা ফিফটি অবধি করেননি, বাজি ধরাটা তাই সহজ ছিল না ভারতের জন্য। তবে বাজির ঘোড়া হিসেবে চেতন কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্টকে আশাহত করেননি। মাত্র ৯৬ বলে ১০১ রান করে তিনি ভারতকে ম্যাচ জিতিয়ে দেন ম্যাচ শেষের ১১ বল আগেই।

তবে এরপরই দুর্ভাগ্য তাড়া করতে শুরু করে চেতনের। সেই মহাকাব্যিক ম্যাচের পর আর মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই তাঁকে বাদ পড়তে হয় ওয়ানডে দল থেকে। সেই যে বাদ পড়লেন, আর সহজে দলে ফিরতে পারছিলেন না চেতন। বেলায় বেলায় মেঘ গড়াচ্ছিল, একে একে  গড়িয়ে যাচ্ছিল অনেক অনেক বসন্ত, কিন্তু চেতনের আর দলে ফেরা হচ্ছিল না। তবে সেই সুযোগ চেতনের সামনে আসে ১৯৯২ সালে। দারুণ একটা ঘরোয়া মৌসুম কাটানোর পর তিনি দলে ফিরেছিলেন অনেক দিন পর; দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে।

তবে, এরপরও টিকে থাকতে পারেননি তিনি। আস্তে আস্তে তিনি চলে গেলেন পর্দার আড়ালে। তবে ক্রিকেটকে তিনি একেবারেই কখনও ছেড়ে যাননি। টেলিভিশন, পত্রিকা, এমনকি সিনেমাতেও তিনি কাজ করেছেন ক্রিকেট নিয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...